Type to search

সব লাশ পড়ে ছিল এক কক্ষে

বাংলাদেশ

সব লাশ পড়ে ছিল এক কক্ষে

কারখানায় ভয়াবহ আগুনে ৫২ জন শ্রমিক নিহতের ঘটনায় গতকাল শনিবার রূপগঞ্জ থানায় হাসেম ফুডসের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছে পুলিশ। এই মামলায় তাঁদের সবাইকে গ্রেপ্তারের পর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে পুলিশ ১০ দিনের

রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত আসামিদের প্রত্যেককে চার দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন।

এর আগে গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুড়ে যাওয়া কারখানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ৫২ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় ন্যূনতম যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাঁদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। ওই সময়ই তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ আট শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলার পাশাপাশি তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে কোনো শিশু শ্রমিক ছিল কি না, থাকলে কতজন শিশু শ্রমিক আছে, সে বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারখানা ভবন নির্মাণে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, সেটিও তদন্তের পরে জানা যাবে।

গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনের সূত্রপাত হয়। এর প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আর আগুন লাগার টানা ৪৮ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেলে উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস। উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ। আগুনে ভবনের কিছু অংশ ধসে গেছে। যে কারণে পুড়ে যাওয়া কারখানা ভবনটি রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ এবং কারখানার কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শীতাতপনিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভেতরে ৪৯ লাশ

প্রাথমিক তদন্তে কারখানার নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাতের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তবে আগুনের সূত্রপাত বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শর্টসার্কিট), নাকি গ্যাস থেকে কিংবা অন্য কোনোভাবে, সেটি এখনো সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তবে একাধিক ভিডিওতে নিচতলা থেকে আগুন পুরো ভবনে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখা গেছে। প্রথম আলোর কাছে আসা একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, আগুন লাগার পরপরই অনেক শ্রমিক বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। এঁদের মধ্যে তিনজন মারা যান। আর উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনির হোসেন বলেন, ভবনের চারতলায় উত্তর-পশ্চিম পাশের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বড় কক্ষের ভেতরে ৪৯টি লাশ পড়ে ছিল।

চারতলায় চকলেট তৈরির কাজ করত তিথি সরকার (১৪ বছর)। সে প্রথম আলোকে বলে, প্রচণ্ড ধোঁয়ায় যখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তখন তারা মোট ১২ জন দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যায়। তার চাচাতো বোন কম্পা বর্মণ ছাদে না গিয়ে এসি রুমে আশ্রয় নেয়।

ভবনের চতুর্থ তলায় কাজ করতেন আকিমা খাতুন। তাঁর ছেলে মোস্তাকিনও একই কারখানায় কাজ করেন। বৃহস্পতিবার রাতের পালায় তাঁর কাজ করার কথা ছিল। এর আগেই কারখানায় আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে যান। আগুন লাগার পর ফোনে তাঁর মা বলেছিলেন, ধোঁয়া থেকে বাঁচতে তাঁরা এসি রুমে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর মায়ের নাম এখন নিখোঁজদের তালিকায়। তিনি মায়ের লাশ শনাক্ত করতে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।

নিখোঁজের তালিকায় থাকা ২৫ জন শ্রমিকের পরিবারের স্বজন ও বেঁচে আসা ৫ জন শ্রমিকের সঙ্গে গতকাল কথা বলেছে প্রথম আলো। বেশির ভাগ স্বজন দাবি করেছেন, কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তার অনুরোধে সবাই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ কক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

ভবনের পাঁচতলায় কাজ করতেন শ্রমিক জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আগুন লাগার কয়েক মিনিট পর তাঁরা জানতে পারেন আগুন লেগেছে। যখন ধোঁয়ায় ভবন ভরে যায়, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তখন তাঁরা কয়েকজন পাঁচতলা থেকে ছাদে ওঠার পথে থাকা লোহার বেড়ায় ঝোলানো তালা ভেঙে ফেলেন। পরে ছাদে গিয়ে প্রাণ বাঁচান।

ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চারতলায় যাঁরা একটি কক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁরা যদি দক্ষিণ-পূর্ব পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে পারতেন, তাহলে সবাই বেঁচে যেতেন। কারণ, ছাদে আগুন এসে পৌঁছায়নি।

আগুনের দিনই ৬০ ড্রাম তেল রাখা হয় কারখানায়

ছয়তলা ভবনের নিচতলা ও ষষ্ঠ তলা বাদে বাকি চারটি তলায় খাদ্যদ্রব্যাদি প্রস্তুতের নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান ছিল। হাসেম ফুডসের সহকারী প্রকৌশলী আবু সাঈদ ও ইমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার যেদিন আগুন লাগে, সেদিন সকালে ভবনের চারতলায় ৬০ ড্রাম পাম তেল রাখা হয়েছিল।

সরেজমিনে গতকাল ভবনের দ্বিতীয় তলায় দেখা যায়, জমে থাকা পানির ওপরে তেল ভাসছে। এই তলায় টোস্ট (বিস্কুট) তৈরি হতো।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, এই কারখানায় একাধিক খাদ্যদ্রব্য তৈরি হতো। এগুলো প্যাকিং করার জন্য ফয়েল পেপার, প্লাস্টিকের বোতল ছিল। নিচতলায় কয়েক টন প্যাকিং কাগজের রোল ছিল। রাসায়নিক উপাদানসহ এত সব দাহ্য বস্তু পুরো ভবনে ছিল। এ জন্য আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে সময় লেগেছে।

আগুনে পুড়ে যাওয়া এই কারখানা সজীব গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিকানাধীন। তাদের তৈরি সেজান জুসসহ নানা ধরনের খাদ্যপণ্য বাজারে রয়েছে। সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম। তিনি ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে নির্বাচন না করার কথা জানান দলকে। পরে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছেন। কিন্তু দল তাঁকে আর মনোনয়ন দেয়নি।

আট আসামি

আগুনে ৫২ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে করা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আট আসামি হলেন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হাসেম, তাঁর ছেলে ও ডিএমডি হাসীব বিন হাসেম, পরিচালক তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীম। এ ছাড়া প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহান শাহ আজাদ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম প্রথম আলোকে বলে, গত শুক্রবার গভীর রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।সূত্র,প্রথম আলো