চিকিৎসকরা বলছেন, খুলনাঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ হচ্ছে তাতে অক্সিজেন যেন সোনার হরিণ হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ অনুসন্ধানীতে খুলনা বিভাগে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শীতকালে সংক্রমণ তেমন না বাড়ার কারণে সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও অংশগ্রহণ, এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়ে উদাসীনতা, বিয়ে-সাদি, ওয়াজ মাহফিল, ভ্রমণ করোনা ছড়িয়ে পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে। সর্দি জ্বরের সিজন হওয়ায় শহর ও গ্রামের অনেকে এটা অবহেলা করছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ প্রাপ্তদের দিয়ে খুলনার ১৩০ শয্যা ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা চলছিল। অনভিজ্ঞদের দিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ফলে পজিটিভ-নেগেটিভ একীভূত হয়ে যাওয়ায় গত বুধবার (৩০জুন) রাতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবে ৫শ রোগীর নমুনাই পজিটিভ আসে। আর একারণে ল্যাবটি আপাতত বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার পর অনেকের মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছিলো তিনি করোনার ঝুঁকিমুক্ত। তাই আর স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও চলবে। রাস্তাঘাট, বাজার, শপিংমলে খুব কম মানুষ মাস্ক ব্যবহার করতেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে মাস্ক পরেনি অধিকাংশই। ফলে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। ভারতফেরত পাসপোর্ট যাত্রীদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল, কিন্তু তারা অনেকে পালিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। এতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। আবার কেউ কোয়ারেন্টিনে থাকেনি। ভারতের সীমান্তবর্তী খুলনার জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণরোধে বিধিনিষেধ আরোপের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ঈদের সময় সরকারের বিধিনিষেধ না মেনে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার ঘটনায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
কেউ কেউ বলছেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় খুলনার উপকূলীয় উপজেলায় সাইক্লোন সেন্টারে গাদাগাদি হয়ে মানুষ থাকার কারণে ওই এলাকায় করোনার সংক্রমণ বেড়েছে।
খুলনা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিক্যাল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা বলেন, গত বছর কিন্তু এই সময়ে করোনা বেড়েছিলো এ বছরও ঠিক সেই সময়ে বেড়েছে। এবার বেশি হওয়ার কারণ ভ্যারিয়েন্টের তীব্রতা। করোনায় আক্রান্তদের যে সংখ্যাটা আসছে এর বাইরেও প্রতিটি পরিবারে কারও না কারও করোনার লক্ষণ রয়েছে। সর্দি জ্বরের সিজন হওয়ায় অনেকে এটা অবহেলা করেছে। এর কারণে করোনা বেড়ে গেছে। হাসপাতালে যারা মারা যাচ্ছে তারা অধিকাংশ ৬০-৭০ বছর বয়সের। এদের যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন আর আইসিইউতে নিয়েও কিছু করার থাকে না। এছাড়া শত চেষ্টার পরও সচেতনা তৈরি করতে পারিনি আমরা। মাস্কের ওউপর কোনোটাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।
গত বছর মানুষ আতঙ্কে ঘর থেকে বের হননি কিন্তু এ বছর তেমন দেখা যাচ্ছে না এর কারণ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সয়ে গেছে সবার। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও খুলনার মৃত্যুর হারটা দিয়ে চলমান লকডাউনে মানুষকে একটু আটকে রাখা যাচ্ছে। এই দুইটা দিয়ে খুলনাবাসীকে একটু সচেতন করা গেছে। তা না হলে মানুষদের আটকানো যেতো না। এছাড়া সেনাবাহিনী দিয়ে একটু আটকানো যাচ্ছে। এটা যদি আর একটু আগে করা হতো তাহলে হয়তো এত ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো না।
সবাইকে পরামর্শ দিয়ে ঊষা বলেন, মাস্ক, মাস্ক এবং মাস্ক। মাস্কই পারে সব ধরনের ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষা করতে।
খুলনায় এতো করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, শুধু খুলনায় নয় অনেক জেলাতেই ভয়াবহ অবস্থা। খুলনার মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এটা তো সংক্রমিত রোগ। এক জন থেকে অন্যজনে ছড়ায়। স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা থাকলেও কেউ মানছেন না। মাস্ক পড়ছেন না। ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করলেও মাস্ক পরছে না অনেকে। সংক্রমণ হওয়ার আর কোনো রাস্তা তো দেখি না আমরা। এটাই মূলত এক নাম্বার কারণ।
সিভিল সার্জন বলেন, সরকার থেকে শুরু করে মিডিয়াসহ আমরাও সচেতনতার কথা বলছি কিন্তু চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী। সবাই ভাবে কিছু তো হয় না। কিন্তু হচ্ছে তো। যার হচ্ছে তার পরিবার বুঝছে কি হচ্ছে। যার চলে যাচ্ছে তার পরিবারই বুঝছে কি ভুল তারা করেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই সরকার বাধ্য হলো লকডাউন দিতে। লকডাউন মানে কি মানুষকে বাসায় আটকানো। নিশ্চয় স্বাস্থ্যবিধি মানছে না সে জন্যই বাসায় আটকানোর চিন্তা করে সরকার লকডাউন দিয়েছে।
খুলনাঞ্চলের করোনা কি ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, না আমরা তো সেরকম কিছু দেখি না। ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সয়লাব হয়ে গেছে এমন রিপোর্ট তো আসে না। যশোর, সাতক্ষীরার দিকে কিছু আছে। আমাদের এখানে কোনোটার আধিক্য তেমন নেই।
খুলনায় করোনা এত বেশি হওয়ার কারণ কী? জানতে চাইলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক রাশেদা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, সব জায়গাই তো বেড়েছে সে হিসেবে খুলনাতে তোও বেড়েছে। মৃত্যুর হার খুলনায় একটু বেশি। সাধারণ সর্দি জ্বর ভেবে একটু দেড়িতে চিকিৎসকের কাছে আসছেন রোগীরা। এখনের যে ভ্যারিয়েন্ট তা আগে থেকে বোঝাও যাচ্ছে না। রোগীও বুঝতে পারে না তিনি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
তিনি রোগীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, একটু আগে আগে চিকিৎসকের কাছে আসার জন্য বলবো। আগে আসলে তার অবস্থা বুঝে চিকিৎসা করা গেলে সেভ করা সম্ভব হতে পারে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষদের বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে সেবা নিতে।
সূত্র, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক :
মোঃ কামরুল ইসলাম
মোবাইল নং : ০১৭১০৭৮৫০৪০
Copyright © 2025 অপরাজেয় বাংলা. All rights reserved.