তৌহিদ জামান, যশোর
চূড়ান্ত বিজয়ের তখনও মাস দুয়েক বাকি। চলছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। এসময়টায় যশোরের মণিরামপুর-কেশবপুর অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে তটস্থ করে রাখছিলেন আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি ও ফজলুর নেতৃত্বে প্রচণ্ড সাহসী আর মেধাবী মুক্তিসেনার দল।
তাদের সর্বব্যাপী কৌশলী গেরিলা তৎপরতা ঘুম নষ্ট করে দেয় পাকি হানাদার আর তাদের বশংবদ রাজাকারদের। এ পরিস্থিতিতে বর্বর পাকি আর তাদের দোসর রাজাকারের দল মরিয়া হয়ে ওঠে দুর্দমনীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলটিকে অকার্যকর করতে।
১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর এ রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেদনাহত এক দিন। পাকিদের কলজে-কাঁপানো সেই বীর মুক্তিবাহিনী সদস্যরা ধরা পড়েন ঘৃণ্য রাজাকারদের হাতে। ওই রাতেই মণিরামপুরের চিনেটোলা বাজারের পাশের হরিহর নদীর ব্রিজের ওপরে সেই সূর্য সন্তানদের নৃশংসভাবে খুন করে পাপিষ্ঠ রাজাকারের দল।
সেদিনের সেই দুঃসহ বিভৎস স্মৃতি আজও তাড়িয়ে ফেরে যে মানুষটিকে, তার নাম শ্যামাপদ দেবনাথ। তিনি নিজ হাতে কবর দেন সেই মুক্তিসেনাদের। প্রায় এসে সযতনে পরিষ্কার করেন কবরের ওপরের ঝোঁপ-ঝাড়। একাত্তরে তিনি মুটেশ্রমিক ছিলেন, আজ প্রায় ৮৫ বছর বয়সেও একই কাজ করছেন। বড় এক পরিবার নিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে পার করেন সময়।
শ্যামাপদ দেবনাথ বলেন, ‘সেদিন রাতে আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি ও ফজলুসহ ছয়জনকে ধরে আনে রাজাকাররা। রাজাকারদের সঙ্গে একজন পাকি সেনা ছিল। পাকিটা বলেছিল, মেরে কাজ নেই, ওদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এর জবাবে রাজাকাররা বলে, এদের গুলি করে না মারলে আমাদের সুখ-শান্তির দেশ আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
সেদিনের সেই শোকাবহ দিনের স্মৃতিচারণ করে শ্যামাপদ বলেন, ‘এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পানি খেতে চায়। রাজাকাররা পানি দিতে নিষেধ করে বলে, ওদের মুত (প্রস্রাব) খাওয়াতে হবে। আমি গোপনে মাস্টারদের বাড়ি থেকে বালতি এনে তাদের যখন পানি খাওয়াচ্ছি, সেসময় এক রাজাকার এসে আমার পিঠে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে বলে, পানি খাওয়ালি ক্যান, মুতে দে...’
শ্যামাপদ বলেন, ‘এরপর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের একজন করে সামনে আনে আর বেয়োনেট দিয়ে খোঁচায়। ওরা চিৎকার করে পড়ে গেলে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। এভাবে পাঁচজনকে হত্যা করে নদীর মধ্যে ফেলে দেয়। একজন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন।’
পরদিন সকালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ নদী থেকে তুলে জমির মালিক অমূল্য দেবনাথ ওরফে চানমনি কবিরাজের কাছ থেকে দু’আনা দিয়ে জমি কিনে এক গর্তে পাঁচজনকে মাটিচাপা দেন বলে জানান তিনি।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার হরিহর নদীর পারে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ এই পাঁচ বীরযোদ্ধা। যুদ্ধের ওই বৈরি আর বিপদসংকুল সময়ে এখানেই একটি গর্ত করে একই সঙ্গে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। এখানকার মানুষ ভালোবেসে তাদের নাম দিয়েছে সূর্যসন্তান।
তবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্মরণে আজ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। শহীদদের স্বজনরা নিজেদের উদ্যোগে কোনোরকমে সমাধিস্থলটি পাকা করেছেন। আর বছরের এ দিনটিতে শুধু স্বজনরাই সেখানে যান।
সেদিনের শোকাবহ ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে স্থানীয় পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, ‘তখন রমজান মাস। রাত ৮টা সাড়ে ৮টা হবে। হঠাৎ ফায়ারের শব্দ। পাড়ার সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। সকালে এসে দেখি মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ। সকালে মজিদ রাজাকার সেখানে ছিল। সে বলে, লাশের গায়ে হাত দিলে গুলি করা হবে।’
শহীদদের যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সেই জমির মালিকের ছেলে অমল দেবনাথ বলেন, ‘আমার বাবা সে সময় মেম্বার ছিলেন। নিহতদের স্বজনরা বাবাকে জানান কবর দিতে হবে। বাবা জানান তার জমি আছে। এখানে হরিহর নদীর পাশেই কবর দেওয়া হোক। টাকা লাগবে না। কিন্তু ওনারা জানান, কবর দিতে হলে জমি কিনে নিতে হয়। বাবা তখন নামমাত্র দু’আনা পয়সা নেন।’
স্থানীয় আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক তপন কুমার দে বলেন, ‘প্রতিরাতেই আমরা গুলির শব্দ শুনতাম। সেদিন রাতে ২০-২৫ রাউন্ড গুলির শব্দে আমরা ভাবি, আজ বড় ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেছে। সকালে উঠে শুনলাম পাঁচটি লাশ ভাসছে নদীতে। তারপর শ্যামা কাকা সেসব লাশ নিজে তুলে এনে কবরস্থ করেন।’
শ্যামাপদ দেবনাথ জানান, সে রাতে ঘটনাস্থলে রাজাকারদের মধ্যে স্থানীয় কমান্ডার ডা. মালেক, মজিদ রাজাকার, আজিজ রাজাকার, ইসাহকসহ অন্য রাজাকাররা ছিল।
বিচার হয়নি খুনি রাজাকারদের
.......….......
শহীদ পাঁচ সূর্যসন্তানের খুনিদের অনেকে আজও প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে এলাকায় অবস্থান করছে। বেঁচে আছেন ওই ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীও। তবুও বিচার হয়নি ওই নরপিশাচদের।
কথা হয় শহীদ আসাদের সেজভাই বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শফিকউজ্জামানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আসাদ আমার ছোটভাই। সেসহ অপর শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি এ হত্যার বিচার হওয়া উচিত। যারা হত্যা করেছে, তাদের কয়েকজন এখনও জীবিত আছে। তারা এলাকায় সদর্পে চলাফেরা করছে। সরকারের উচিৎ তাদের বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তি দেওয়া।’
উল্লেখ্য, মজিদ রাজাকার সম্প্রতি মারা গেছে। মৃত্যুর আগে সে প্যারালাইজড হয়ে যায়। এক সময়ের প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী ওই রাজাকার পরে চিনেটোলা বাজারে ভিক্ষা করতো। স্থানীয়রা তাকে কোনও সহায়তা করতো না রাজাকার ছিল বলে। মারা গেছে রাজাকার আজিজ এবং ইসাহকও।
☀️
তারকার ন্যায় জ্বলজ্বলে সেই শহীদদের পরিচয়
মাশিকুর রহমান তোজো:: সেই কালোরাতে নিহত বীরযোদ্ধাদের মাঝে ছিলেন মাশিকুর রহমান তোজো। তিনি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকচুয়ারিতে (বীমা বিষয়ক পরিসংখ্যানবিদ) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করেছিলেন।
আসাদুজ্জামান আসাদ:: আসাদ ছিলেন যশোর সরকারি এমএম কলেজের ভিপি ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় যশোর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক।
সিরাজুল ইসলাম শান্তি:: সিরাজুল ইসলাম শান্তি ছিলেন যশোর জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
আহসানউদ্দিন খান মানিক:: আহসানউদ্দিন খান মানিক জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
ফজলুর রহমান ফজলু:: ফজলুর রহমান ফজলু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
🫂
প্রকাশক ও সম্পাদক :
মোঃ কামরুল ইসলাম
মোবাইল নং : ০১৭১০৭৮৫০৪০
Copyright © 2025 অপরাজেয় বাংলা. All rights reserved.