Type to search

মিন্নিকে ফাঁসিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের রক্ষার চেষ্টা!

জাতীয়

মিন্নিকে ফাঁসিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের রক্ষার চেষ্টা!

 

 

অপরাজেয় বাংলা ডেক্স: বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষী তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির গ্রেফতার ও রিমান্ড নিয়ে সারা দেশ যখন তোলপাড়, ঠিক তখনই জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বললেন, খুনের সঙ্গে মিন্নি জড়িত। এসপির এই সংবাদ সম্মেলনের পর থেকেই স্যোশাল মিডিয়ায় শুরু হয় নানা গুঞ্জন। অভিযোগের আঙ্গুল উঠে পুলিশের এসপির দিকেও।

বন্দুকযুদ্ধে প্রধান আসামি নয়ন বন্ডের মৃত্যু, মিন্নির গ্রেফতার চেয়ে নয়নের মা এবং মিন্নির শ্বশুরের হঠাৎ সোচ্চার হওয়া, মিন্নির সঙ্গে খুনি নয়ন বন্ডের প্রেমের গল্প সামনে আনা, পোষ্য অনলাইনের মাধ্যমে কাবিনের কাগজ ছড়িয়ে দেওয়া, বরগুনার দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির দৌড়ঝাঁপ এবং মিন্নির গ্রেফতার চেয়ে স্থানীয় এমপিপুত্র অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথের নেতৃত্বে মানববন্ধন- একে একে এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রতিদিনই খুনের তদন্তে নিত্যনতুন নাটকীয় মোড় দেওয়ায় সব মহলেই এখন প্রশ্ন- বরগুনায় আসলে হচ্ছেটা কী? তাদের প্রশ্ন- নয়ন বন্ড কেন বন্দুকযুদ্ধে, মিন্নি কেন রিমান্ডে? মিন্নির বাবার অভিযোগ, মিন্নিকে গ্রেফতারের বিষয়টি ষড়যন্ত্র। মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত এবং এই খুনের সঙ্গে জড়িতদের আড়াল করার জন্যই এগুলো সাজানো হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন পুলিশ সুপার। রিফাত খুনের পর খুনির পৃষ্ঠপোষক ও অর্থদাতাদের নাম যখন বেরিয়ে আসছিল নানাভাবে, ঠিক তখন থেকেই বরগুণার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের জন্ম নেয়। সেই রহস্য আরও ঘণীভূত হয় মিন্নির পক্ষে কোন আইনজীবী না দাড়ানোতে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেছেন, ‘গত কয়েকদিনে যে ঘটনা ঘটেছে তা আসলে বলার মতো নয়। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি তা নিয়ে এক ধরনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যখন অপরাধীর পক্ষে মানুষ দাঁড়ায়, অথচ সেখানে তাদের দাঁড়ানোর কথা নয়। আর মিন্নিকে যে আসামি করা হয়েছে তা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। এ থেকে সমাজের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। বরগুনায় যা হয়েছে সে ঘটনার পুরোটাই মানুষের দেখা। সবাই জানে কী হয়েছে। এখানে প্রমাণের আর কিছু নেই। যে বিষয়টি চোখের সামনে ঘটেছে, আমাদের বিচার চাওয়ার বিষয় সেখানে। পেছনের কারণ আবিষ্কার করা এর সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়।’ আদালতে মিন্নির পক্ষে আইনি সহায়তা না দেওয়ায় তিনি বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মালেকা বানু বলেন, ‘প্রকাশ্যে একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যার সাহস কারা পায়? এর পেছনে কারা থাকতে পারে তা খুলে বলার প্রয়োজন নেই। এটি সবাই জানে, সবাই বুঝতে পারে। কতটা সাহস আর প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খুনের ঘটনা ঘটানো যায়। এই খুনের ঘটনায় একজন প্রধান সাক্ষীকে আসামি বানানোর বিষয়টি কার আঙ্গুলের ইশারায় হয়েছে তাও বুঝতে কারও বাকি নেই।’

তিনি বলেন, ‘এই খুনের নেপথ্যে যারা আছেন তারা খুবই ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী। তাদের কাছে দুনিয়ার সবই হার মেনে যাবে। আমরা খুবই সাধারণ মানুষ, তাদের কাছে খুবই সামান্য। আমরা তাদের হাতে যে কোনো সময় শেষ হয়ে যেতে পারি। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, আমাদের এ ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচান।’ অভিযোগ উঠেছে, যা হচ্ছে এখন, রিফাত হত্যার আসামিদের বিচার নয়, খুনিদের পৃষ্ঠপোষকদের রক্ষা করতেই সবাই ব্যস্ত। চিহ্নিত নয়ন বন্ড কার লোক তা বরগুনা নয়, সারা দেশের মানুষই এখন জানতে পেরেছে। বরগুনার প্রভাবশালী দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে যে সিন্ডিকেট ছিল নয়ন বন্ড ছিল সেই সিন্ডিকেটের অন্যতম লাঠিয়াল। এসব বিষয় ধামাচাপা দিতেই যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এরা। আর এই রক্ষা করার মূল কাজটি হচ্ছে পুলিশের নেতৃত্বে। এ অবস্থায় দেশের বিশিষ্টজনেরা মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, প্রভাবশালীরা এতটাই শক্তিশালী যে, মিন্নির পক্ষে আইনজীবী পর্যন্ত কেউ ছিলেন না। আইনজীবী না থাকলে ন্যায়বিচারও পাবেন না মিন্নি।

মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তির পক্ষে আইনজীবী নিয়োজিত না থাকলে তার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। একটা মামলার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য শুনে, বিভিন্ন প্রমাণ পর্যালোচনা করে, দুই পক্ষের সব ধরনের বক্তব্য আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন বিচারক।’ এ রকম একটি মামলার ক্ষেত্রে মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বা স্বচ্ছ বিচার হিসেবে গৃহীত হবে না বলেও মনে করেন। বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতারের পর গতকাল আদালতে নেওয়া হলে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী লড়তে রাজি হননি। মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেনের অভিযোগ, প্রভাবশালী মহলের চাপে বরগুনার কোনো আইনজীবী তার মেয়ের পক্ষে লড়তে রাজি হননি।

এ প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেখা গেল আসামিপক্ষে ২২ জন আইনজীবী দাঁড়িয়ে গেছেন। অথচ মিন্নির পক্ষে কেউ নেই। মিন্নি পরিস্থিতির শিকার। সে যদি হত্যা পরিকল্পনায় জড়িতও থাকে, তবু সে পরিস্থিতির শিকার হয়ে তা করেছে। সে প্রতিটি ক্ষেত্রে চাপের মুখে থেকে নানা কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। যখন রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তখন তাকে কেউ সাহায্য করতে আসেনি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যতক্ষণ না কেউ প্রমাণিত হয় ততক্ষণ কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।’ এ ছাড়া মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ঢাকা থেকেও আইনজীবী পাঠানোর চিন্তা করছেন তারা।

এসপির সংবাদ সম্মেলন : বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িত থাকার কথা তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি স্বীকার করেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন। মামলার তিন নম্বর আসামি মো. রাশিদুল হাসান রিশান ওরফে রিশান ফরাজীকে (২০) গ্রেফতারের পর গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি। দুপুর ১২টায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বরগুনার এসপি মারুফ হোসেন বলেন, ‘এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং মিন্নির কথা থেকে পাওয়া সুস্পষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মিন্নিকে এ মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিন্নি এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে জানতেন। শুরু থেকে এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এ হত্যাকান্ডে ঘটাতে যা যা প্রয়োজন, সব ধরনের মিটিং করেছেন হত্যাকারীদের সঙ্গে।

মিন্নির নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি মহিলা পরিষদের : বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষী তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে সারা দেশে সংঘটিত নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তারা।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৬ জুলাইয়ের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হত্যার শিকার রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মহিলা পরিষদ মনে করে, আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময়ে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

দেশের আইনজ্ঞ, যারা আইনের ব্যাখ্যা করেন, তাদের মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতা কতটুকু আছে তা জানা দরকার। বহু গুরুতর অপরাধ, শত খুনের আসামির পাশেও তারা দাঁড়ান। নারী নির্যাতন না শুধু, হত্যাকারীদের পাশেও দাঁড়ান।…সুতরাং ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়, চাপ বা অন্য কারণে যা কিছু হোক বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আইনানুগ, স্বচ্ছ তদন্ত এবং আসামিরও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি দাবি করে। মহিলা পরিষদ চায়, স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, উচ্চ মহলের প্রভাবমুক্ত, রাজনৈতিক চাপমুক্ত, উচ্চ প্রশাসনিক চাপমুক্ত বিচারিক প্রক্রিয়া যেন এখানে হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আধিপত্যমুক্ত, কোনো ধরনের ভয়ভীতিমুক্ত বিচার দাবি করছে। একই সঙ্গে রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্তসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অভিযুক্ত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দাবি জানাচ্ছে।

সূত্র- নতুন সময়, আমাদের সময়.কম