বিভেদ সংঘাত ছড়ানো ক্ষতিকর

সমাজে শান্তি বিনষ্ট হয় মানুষের স্বার্থপরতা, হিংসা ও লোভ থেকে। কখনো অর্থ-সম্পদের লোভ, কখনোবা শক্তি-ক্ষমতার লোভ। অথচ সামাজিক সঙ্ঘাত, হানাহানি, অপতৎপরতা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এসব কাজে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা, দূর থেকে কোনো প্রকার ইন্ধন যোগানো, বিভেদের পালে হাওয়া যোগানো কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে উঠে মহান আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমত ও দয়ায়। এখন কেউ যদি এমন সব তৎপরতার সাথে জড়িয়ে যায়, যে কারণে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে সঙ্ঘাত, উস্কে উঠে বিভেদ তাহলে আল্লাহ তায়ালার কাছে সে একজন জঘন্য অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।
মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ট জীব হিসেবে। ‘মানুষ’ একদিকে সৃষ্টির সেরা জীব। তাদেরকে দেয়া হয়েছে বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান। যা দিয়ে মানুষ জানতে ও বুঝতে পারে ভালো ও মন্দের পার্থক্য। অপরদিকে এই মানুষের মাঝেই লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকারতাসহ নানা অমানুষিক ও অনৈতিক কার্যকলাপও দেখা যায়। একটি সমাজ গড়ে উঠে মানুষকে ঘিরে। তবে মনুষ্যত্ব বিহীন সমাজ কখনো সভ্য সমাজ হতে পারে না। সমাজে শান্তি বজায় রাখা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ধর্মের মানুষ বসবাস করে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ উদাহরন হিসেবে আজও বিশ্বে শান্তির বারতা পৌঁছে দিচ্ছে। তবে দিন দিন মানুষের মধ্যে ‘আমিই সঠিক’ ‘আমারটা-ই সঠিক’ এই চিন্তা-দর্শন প্রকট হওয়ার ফলে আগের দিনের সেই সম্প্রীতি ফিকে হয়ে আসছে। সমাজে শান্তির জন্য দরকার পরমত সহিষ্ণুতা। কিন্তু কী ধর্ম, কী রাজনীতি, সমাজনীতি! সর্বত্র অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলেছে। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থে আমরা মানুষকে মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করছি। আমরা কি পারি না ভালোবাসা দিয়ে একে অপরকে সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে!
আজকের সমাজে কতিপয় মানুষ আছে যাদের কাজই হলো দ্বন্দ্ব লাগানো। সমাজে এক ধরনের মানুষ আছে এই ঝগড়া লাগিয়ে আনন্দ পায়। এর মধ্যে নিজেদের আয়-উন্নতি অনুসন্ধান করে। বিশেষ করে কতিপয় রাজনীতিবিদ, আইনবিদ এরা এতটাই নোংরা মানসিকতার যে, তারা চেষ্টা করে যে কোনোভাবে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যেন ঝগড়া লেগেই থাকে। তারা সমাধানের পথে না গিয়ে কিভাবে ঝগড়া আরো বাড়বে, তার চেষ্টা করে। মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার উপাদান তৈরি করে দেয়। তারা আল্লাহ তায়ালার দরবারে কী জবাব দিবে?
আমরা একটি শান্তির সমাজ চাই। ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত সমাজ শক্তিশালী ও শান্তির সমাজ। যে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা নেই, সে সমাজের মানুষ চরম অশান্তিতে ভুগতে থাকে। তাদের অন্যরা সহজেই ব্যবহার করতে পারে। এটা শুধু পরিবারের মধ্যেই সীমিত নয়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই কুরআনিক এই নির্দেশনা প্রযোজ্য। কোনোভাবে এর ব্যত্যয় ঘটে এমন কোনো কাজ কোনো ঈমানওয়ালা করতে পারে না। পবিত্র কুরআনে সকল মুমিনকে পরস্পরে ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হতে পারে। এটা অসম্ভব নয়।
রাসুল স. বলেছেন, ‘একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তাকে অত্যাচার করবে না এবং তাকে শত্রুর কাছে সমর্পণও করবে না। আর যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো। সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারিতই হোক, যদি সে অত্যাচারী হয় তবে তাকে তার অত্যাচার করা হতে বাধা প্রদান করো। আর যদি সে অত্যাচারিত হয় তবে তাকে সাহায্য করো।’ (দারেমি)
রাসুুল সা. আরও বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের মধ্যে দয়ামায়া এবং সহমর্মিতার একটি দেহের মতো। দেহের একটি অংশে ব্যথা হলে সর্বাংশে তা অনুভূত হয়। (বুখারি ও মুসলিম)।’ আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা এক সময় এমন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে অবদ্ধ ছিলাম। তখন গ্রামের দৃশ্য উঠে আসতো শিল্পীর গানে। ‘গ্রামের নওজাওয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাংলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম….আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ সমাজটা ছিলো সুন্দর। ছিলো না হিংসা-বিদ্বেষ।
পবিত্র কুরআন এ জন্যই ঘোষণা করেছে যে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই অতি উত্তম যে তাকওয়াবান।’ তাকওয়া অর্থ খোদভীতি। যার মধ্যে ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত থাকে। তাকওয়াবান বলতে স্বশাসিত মানুষকে বোঝায়। আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী মানুষকে বোঝায়। যে অন্যায়কে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয় না। নিজে অন্যায় করে না, কেউ অন্যায় করলে সেটা প্রশ্রয় দেয় না। উপরন্তু কোথাও অন্যায় হতে দেখলে তা সামর্থ্য অনুসারে সবটুকু দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে।