স্বাধীকারের সূত্রপাত ভাষা ও সংস্কৃতি :
আমরা জানি, ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছিলো। হাজার মাইলের ব্যবধানে দুটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা। সুতরাং শুধু ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে দুই জনগোষ্ঠীকে যুক্ত রাখার জন্য পাকিস্তানের শাসকরা তাদের দ্বিজাতিতত্ত্বের নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। সে জন্য তারা আমাদের জাতিপরিচয় বিস্মৃত করে শুধু ধর্মপরিচয়ে নিজেদের শনাক্ত করার প্রচেষ্টা করে। এভাবে তারা আমাদের মনোজগতে ও সমাজে আত্মপরিচয়ের সংকট সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নেয়। আর এ জন্য প্রথম ও ধারাবাহিক আঘাতটি আসে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। সে কারণে পাকিস্তানের শাসকরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস গ্রহণ করে। এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়। পাশাপাশি এ অঞ্চলের বাঙালিকে তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলে। এ জন্য রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালন বাধাগ্রস্থ হয় এবং অবশেষে রবীন্দ্র সংগীত ও সাহিত্য গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়। কাজী নজরুল ইসলামের গানের বাণীর বৈচিত্রময় ভা-ারকে খ্যাতিরূপে প্রচারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসররা সচেষ্ট হয়।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিলে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এর প্রতিবাদ করেন। শুধু তাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতি ও মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মূলধারার আন্দোলন ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের। ফলে বাঙালি জাতির স্বাধিকার অর্জনের রাজনৈতিক সংগ্রামের সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়েছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। তার পরিচয় পাওয়া যায় প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন, প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে সংগীতানুষ্ঠান, যেখানে রবীন্দনাথ ও নজরুলের স্বদেশ পর্যায়ের গানের পাশাপাশি চলে লোকশিল্পীদের অমর সংগীত ও গণসংগীত পরিবেশনা।
নোবেলজয়ী বাংলা সাহিত্যিক করিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতা পরিহার করে ধর্মের মর্মবাণী উপলব্ধি করার শিক্ষা দিয়েছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে দ্রোহের গান গেয়েছেন, আবার তিনি ধর্মের অপব্যাখ্যার ফলে সমাজে যে অবিচার ঘটে তার বিরদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাই পাকিস্তান আমলে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সঙ্গে সমান্তরাল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাঙালির মানস গঠনে বিশাল ভূমিকা রেখে পাকিস্তানের শাসকদের সব পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনগণ তাদের ধর্মপরিচয় ও বিশ্বাসকে অক্ষুণœ রেখেই জাতিপরিচয়ে ধন্য হয়ে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।
এদেশে রবীন্দ্র চর্চা যেমনিভাবে হয়ে থাকে তেমনি নজরুলের বাণী ও সুরে শৃঙ্খলা আনার জন্য নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল সংগীত শিল্পী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রবীন্দ নাথ ও নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট উদ্যোগ গ্রহণ করছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও তার বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। সামগ্রিকভাবে ভাষা সংস্কৃতিক্ষেত্রে প্রাণচাঞ্চল্য দৃশ্যমান।
বাঙালির শত অর্জনের মাঝে সাংস্কৃতিক অর্জনও কম নয়। তবে সুস্থ সুন্দর ও মননশীল সাংস্কৃতিক অঙ্গন গঠনে সরকারি বেসরকারি প্রচেষ্টা অব্যহত থাকা দরকার। নতুন পটভূমিতে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছি। জীবনাচারে পাশ্চাত্যের অনুকরণে আধুনিকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদের রক্ষণশীলতা সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে আত্মপরিচয়ের সংকটের নতুন ধারার জন্ম দিতে হবে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে দেশের সকল সমাজসচেতন সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা মানুষের যথাযথ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
প্রকাশক ও সম্পাদক :
মোঃ কামরুল ইসলাম
মোবাইল নং : ০১৭১০৭৮৫০৪০
Copyright © 2025 অপরাজেয় বাংলা. All rights reserved.