Type to search

পাট শিল্পে আকিজ গ্রুপের সফল্য

ব্যবসা বানিজ্য

পাট শিল্পে আকিজ গ্রুপের সফল্য

 

সৈয়দ আরাফাত হোসেন (তাজ) অভয়নগর(যশোর) প্রতিনিধি : করোনাকালে দেশের প্রায় সব শিল্প খাতেরই রফতানি ছিল পতনের ধারায়। ব্যতিক্রম পাট খাত। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও রফতানি বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ হারে। এ অর্জন এমন এক সময়ে এসেছে, যখন সরকার দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকলই বন্ধ করে দিয়েছে। রফতানি পরিসংখ্যান বলছে, পাট খাতের এ অর্জনের পেছনে আকিজ পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি।
আকিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে গড়ে ওঠা পাটকলগুলোর প্রতিটিই ব্যবসায়িকভাবে সফল। আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিনের হাতে গড়ে ওঠা আকিজ জুট মিলস লিমিটেড এখন বিশ্বের বৃহত্তম পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরে আছেন সেখ আকিজ উদ্দিনের ছেলে শেখ নাসির উদ্দিন। আরেক ছেলে শেখ বশির উদ্দিন সম্প্রতি জনতা-সাদাত জুট মিলস ও পারটেক্স জুট মিলের সম্পদ কিনে নিয়েছেন। এছাড়া সেখ আকিজের আরেক সন্তান শেখ আফিল উদ্দিনও জড়িত রয়েছেন পাটপণ্য ব্যবসার সঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে আকিজ পরিবারের সদস্যরাই এখন দেশের পাট খাতের অগ্রযাত্রায় চালকের ভূমিকায় রয়েছেন।
দেশের পাট খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারি পাটকলগুলো কোনোদিনই এ বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি শতকের শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ধুঁকেছে, তখনো পাটের ওপর থেকে আস্থা হারাননি উদ্যোক্তা সেখ আকিজ উদ্দিন। প্রথম প্রজন্মের এ বাঙালি মুসলিম উদ্যোক্তা কাঁচাপাটের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। কৃষিপণ্যটি রফতানিও করেছেন। এ কারণেই পাটশিল্পের প্রকৃত সুযোগ-সম্ভাবনা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন তিনি।
বাংলাদেশে পাট খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের সূত্রপাত আশির দশকে। সে সময় কয়েকটি পাটকল ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। সেখ আকিজ উদ্দিনও সে সময় কাঁচাপাটের ব্যবসার পাশাপাশি পাটশিল্পে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের কথা ভাবছিলেন। কিন্তু পাটকল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন না পাওয়ায় সেবার পাটশিল্পে বিনিয়োগের ইচ্ছা আপাতত মুলতবি রাখতে হয় তাকে।
এর কয়েক বছরের মাথায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাট খাত নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা যখন চরমে, ঠিক সে সময় আবার সুযোগ আসে সেখ আকিজ উদ্দিনের সামনে। আবারো পাট খাতে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। সেখ আকিজ উদ্দিন তখন দেশের অন্যতম শীর্ষ কাঁচাপাট রফতানিকারক। এবার পাটকল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পেয়ে গেলেন তিনি।
যশোরের নওয়াপাড়ায় শুরু হয় আকিজ জুট মিল প্রতিষ্ঠার কাজ। এজন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় যন্ত্রপাতি। দুটি ইউনিটে ২৮টি স্পিনিং ফ্রেম নিয়ে পাটকলটির উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। শুরুতে আকিজ জুট মিলের শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৩০০। দৈনিক উৎপাদন ছিল ১০ টন। বিষয়টিতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি সেখ আকিজ উদ্দিন। এজন্য ছেলে শেখ নাসির উদ্দিনকে পাটকল ব্যবসার অভিজ্ঞতা নিতে কলকাতায় পাঠান তিনি। একই সঙ্গে নজর দেয়া হয় শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, উন্নত যন্ত্রপাতিতে উৎপাদন ও কাঁচামালের মানসম্মততা নিশ্চিতের বিষয়ে।
সম্প্রতি লোকসানের বোঝা টানতে না পেরে রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান আকিজ জুট মিলস বড় হতে হতে বর্তমানে পাটপণ্যের বৈশ্বিক বাজারে বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। গুণগত মান ও উৎপাদন সক্ষমতার দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম এখন বিশ্বব্যাপী। আকিজ জুট মিলস লিমিটেড এখন গোটা বিশ্বেই শীর্ষ পাট সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মোট বৈশ্বিক চাহিদার ২৫ শতাংশ একাই সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে এক লাখ টনে। আকিজ জুট মিলের পণ্য রফতানি হচ্ছে প্রায় ৪০টির মতো দেশে। এর ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে ১০ হাজারের বেশি পরিবার। পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। এছাড়া সরকারকে পাট খাতের করদাতা হিসেবেও টানা দেড় দশক ধরে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে পাট খাতের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর পাট খাত অনেকটাই নিগৃহীত ও অদক্ষ ছিল। এক পর্যায়ে ৯০-এর দশকে পাট খাত চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লে আমার প্রয়াত বাবা পাট খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু চল্লিশের দশকে আমার বাবার ব্রিটিশ কোম্পানি র্যালি ব্রাদার্সের সঙ্গে পাট বিপণন ও পাটপণ্যের ব্যবসাসংক্রান্ত দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৯০ সালে মিল স্থাপন শুরু হলেও শেষ হয় ১৯৯৪ সালে। পরিপূর্ণ কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ২১ মার্চ। পাট খাতের সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য বাবা আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে পাটকলের দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনার পাশাপাশি পাটপণ্যের বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনায় বড় পরিবর্তন আনি। সৃষ্টিকর্তার রহমতেই মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাট সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে পেরেছি। দেশবাসীর দোয়া ও সহযোগিতা নিয়ে আগামী দিনে পাটকলে ৫০ হাজার কর্মসংস্থান করার স্বপ্ন রয়েছে। সেজন্য কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে আরো সক্ষমতা বৃদ্ধি করব।
বিশ্ববাজারে পাট সুতার বার্ষিক চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। এর মধ্যে আকিজ জুট মিলস সরবরাহ করছে এক লাখ টনেরও বেশি। গত অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটি পাটজাত দ্রব্যে রেকর্ড পরিমাণ রফতানি আয় করেছে। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির রফতানি আয় প্রথমবারের মতো ১০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। দেশে উৎপাদিত ভালো পাটের সিংহভাগই প্রক্রিয়াজাত করে সুতায় রূপান্তর করছে আকিজ জুট মিলস। বিশ্বের প্রায় ৪০টির মতো দেশে পাটপণ্য রফতানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। আকিজ জুট মিলসে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পাশাপাশি জুট মিলের ওপর পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আরো ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবার। প্রতিষ্ঠানটিকে কাঁচাপাট সরবরাহ করছেন দেশের প্রায় আড়াই লাখ কৃষক।
মাত্র দুটি ইউনিট নিয়ে যাত্রা করা আকিজ জুট মিলসের অধীনে এখন সাতটি কারখানা উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রতিদিন প্রায় ৩৯০ টন সুতা উৎপাদন হচ্ছে।
সম্প্রতি আকিজ পরিবারের পাট সাম্রাজ্যে যুক্ত হয়েছে নতুন দুটি জুট মিল। শেখ বশির উদ্দিন স্বতন্ত্র উদ্যোগে কিনেছেন জনতা-সাদাত জুট মিল। এরপর পারটেক্স গ্রুপের জুট মিলের সম্পদও কিনে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে শেখ বশির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, পাট খাতে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা খুব অল্প সময়ের। কিন্তু পাট খাতে আকিজ গ্রুপের অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো। জনতা-সাদাত জুট মিলের মালিকানার মাধ্যমে এ খাতে প্রবেশের পর আমার মনে হয়েছে কার্যকারিতার চেয়ে আবেগ দিয়েই পরিচালিত হয় বেশি খাতটি। কৃষি থেকে শুরু করে পাট এবং পাটজাত পণ্যের ভোক্তা পর্যন্ত যে সুযোগ বাজারে রয়েছে, সেখানে অনেকগুলো ডট আছে। এ ডটগুলোর সংযোগ ঘটানো হয়নি সঠিকভাবে। ফলে খাতের প্রকৃত সম্ভাবনা বিকশিত হয়নি। এ খাতটির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিকশিত হওয়া প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, পাট ও পাটজাত পণ্যের ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমার মনে হয়েছে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভাবনার মাত্রা অনেক বেশি ওপরে। বর্তমানে পাটজাত পণ্যের বেশির ভাগটাই র্যাপিং ম্যাটেরিয়াল। একটি পাটের বস্তার ক্ষেত্রে দেখা যাবে প্লাস্টিক বস্তার চেয়ে সেটা অপ্রয়োজনীয় ধরনের ভারী। আর পাট খাতের উন্নয়নের চেষ্টা হচ্ছে শুধু রাষ্ট্রীয় সহায়তা কাজে লাগিয়ে। কৃৃষিপণ্য বলে এতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা লাগবেই। কিন্তু শিল্পকেও সঠিক সৃজনশীলতার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ শুধু নিয়ন্ত্রণমূলক সহায়তা কাজে লাগিয়ে এ শিল্পে বিপ্লব সম্ভব হবে না। আমার ছয় মাসের অভিজ্ঞতা বলে পাট খাতে সম্ভাবনা অপার। এ খাতের ভ্যালু চেইনের প্রতি ক্ষেত্রেই অদক্ষতা আছে।
আকিজ পরিবারের আরেক সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনেরও রয়েছে জুট মিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের পরিবারের হাতেই এখন পাটপণ্যের সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা। যে সক্ষমতা বিশ্বের ১ নম্বর পাট সুতা উৎপাদকে পরিণত করেছে আকিজ পরিবারকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *