Type to search

পবিত্র আশুরা ও মহররমের তাৎপর্য ও শিক্ষা

সাহিত্য

পবিত্র আশুরা ও মহররমের তাৎপর্য ও শিক্ষা

-বিলাল হোসেন মাহিনী

হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়।  মররম হিজরি ক্যালেন্ডারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ মাসকে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বলা হয়েছে। কুরআনের ভাষায় এটি (‘আরবাআতুল হুরুম’) তথা সম্মানিত চার মাসের অন্যতম। মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই সময়ের হিসাব গণনার জন্য সূর্য ও চন্দ্রের মাধ্যমে বছরে বারোটি মাস নির্ধারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে মাসগুলোর সংখ্যা হচ্ছে বারো, যেদিন থেকে তিনি মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যে চারটি হচ্ছে পবিত্র মাস।’ (সূরা তওবা : ৩৬)। সেই চারটি মাস হলো রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম।

এ মাসে সিয়াম সাধনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল সা. বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২/৩৬৮; জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৭) রসুলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে সেখানকার ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই দিনে কেন রোজা রাখছ? উত্তরে তারা বলল, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা হজরত মূসা আ. এবং তাঁর উম্মতকে ফেরাউননের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন আর ফেরাউন ও তার দলবলকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। তাই হজরত মূসা আ. কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিনে রোজা পালন করতেন এবং আমরাও তাঁর অনুসরণে এ দিনে রোজা রাখি। তখন রসুলুল্লাহ সা. বললেন, হজরত মূসা সা. এর কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি। অতঃপর রসুল সা. নিজে আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং উম্মতকেও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন (বুখারি : ১৯০০)। তবে রোজা রাখার ক্ষেত্রে ইহুদিদের সাথে যেন সাদৃশ্য না হয় সে জন্যে আগে পরে একটি রোজা বেশি রাখতে বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা পালনের ক্ষেত্রে ইহুদিদে বিরোধিতা করো; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন বেশি রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ : ২১৫৪)।
মহররমের রোজার মধ্যে আশুরার রোজার ফজিলত আরও বেশি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল সা.-কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (সহিহ বুখারি : ১/২১৮)। আলী রা.-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুল সা.-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল সা. বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখো। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৭)।
নবী কারিম সা. বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম : ১/৩৬৭; জামে তিরমিজি : ১/১৫৮) আশুরার রোজা সম্পর্কে এক হাদিসে আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১/২৪১)
আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা :
হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মুহাররম ও আশুরা শোনার সাথে সাথে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে (৬১ হিজরি ১০ মহররম) কারবালার মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, বিষাদময় ও শোকাবহ ঘটনার কথা। তবে হযরত হোসাইন রা. শাহাদাতকে কেন্দ্র করে শরীয়ত বিরোধী অনেক কাজ করতেও দেখা যায়। তার মধ্যে মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, তাজিয়া মিছিল ও শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। অথচ এই কাজগুলো ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা হারাম। যারা এই সকল কাজে অংশ নিবে তাদের ব্যাপারে রসুল সা. কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো স¤পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’ (বুখারি : ১২৩৫)।
ইমাম হোসাইন রা. এবং তার অনুসারীরা ইসলামের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে, সত্য ও ন্যায়ের স্বপক্ষে অবস্থান করতে গিয়ে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নৃশংস ভাবে শাহাদাত বরণ করে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেছেন, একজন মুসলমান হিসেবে সেই আদর্শকে সমুন্নত রাখাই আশুরার মৌলিক শিক্ষা। তার শাহাদাত পৃথিবীর তাবৎ মাজলুমকে সকল অন্যায়, অবিচার ও অত্যচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রেরনা জোগায়। তিনি নিপিড়ীত মানবতাকে শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে অন্যায় ও জুলুমের মোকবিলা করতে হয়। জালিমের সংগে আপোষ নয় প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবাদ করতে হবে।
ইমাম হোসাইন রা. মুসলিম উম্মাহর সামনে নিজের জীবন দিয়ে জয় পরাজয়ের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, শহীদ হওয়া জীবনের পরাজয় নয়; বরং শাহাদাত হচ্ছে জীবনের বড় সফলতা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর রাহে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জেহাদ করেছে, তাদের বড় মর্যাদা রয়েছে আল্লাহর কাছে আর তারাই সফলকাম। (সূরা তাওবা: ২০)। আর জালিম সাম্রাজ্য যত শক্তিশালী হোক না কেন, তার পতন হবেই। জালিম ও স্বৈরাচারীরা অভিশপ্ত হয়ে ইতিহসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। যার প্রমান ইয়াজিদের রাজত্ব, যার পতন হয়েছিল মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদের মৃত্যুর মাধ্যমে। মৃত্যুর কয়েক দিনের মাথায় তার পুত্রের মৃত্যু হয়। এবং এই পরিবার ভবিষ্যতে আর কোনদিন শাসন ক্ষমতা লাভ করতে পারেনি। কারবালার হত্যাযজ্ঞে যারা অংশ গ্রহণ করেছিল তারাও মাত্র দুই বছরের মধ্যে মেখতার সাকাফির হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। কিন্তু ইমাম হোসাইন আজো বেঁচে আছেন আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে। তাঁর ত্যাগ ও শাহাদাতের কারণে যুগের পর যুগ মানব হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না। (সূরা বাকারা : ১৫৪)। মহান রব্বুল আলামিন আমাদেরকে মহররম ও আশুরার যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার তৌফিক দান করুন। সাথে সাথে আশুরাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে প্রচলিত শরিয়ত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমিন।