নৈতিক অবক্ষয় রোধে ইসলামি অনুশাসন

প্রভাষক বিলাল মাহিনী : দেশ কাল স্থান ভেদে নৈতিকতা, সামজিক রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ও শালীন মার্জিত আচরণের ভিন্নতা তথা পার্থক্য থাকলেও কোনো ধর্মই মানুষকে অনৈতিক আচরণ শেখায় না। এমনকি অশ্লীলতা বেহায়াপনাকে কোনো সমাজ ও ধর্মই নৈতিক অনুমোদন দেয় না। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইনের পাশাপাশি ধর্মই আমাদের সবচেয়ে বেশি নৈতিকতার বানী শোনায়। অতএব, ধর্মীয় শালীনতা মার্জিত আচার-আচরণ মানুষকে বিনয়ী হতে এবং অপরাধমুক্ত জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে।
সম্প্রতি যেভাবে অনৈতিকতা অশালীনতা বেড়ে চলেছে, তার জন্য সচেতন মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এভাবে বিলাসী জীবন যাপনের ফলে মানুষের মধ্যে উচ্চাভিলাষ তৈরি হচ্ছে। নিজেদের যৌন আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় বিধান বা ভয়ের তোয়াক্কা করছে না কেউ।
পৃথিবীর সকল ধর্মই শান্তির বানী শোনায়। তেমনি ইসলামও শান্তির ধর্ম। ইসলাম শুধু বিশ্বাসের নাম নয়, বরং বিশ্বাস অনুসারে ইসলামি নিয়ম-নীতি ও অনুশাসন বাস্তবায়নের নামই ইসলাম। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ ‘আত্মসমর্পণ করা’। একজন মুসলিম কুরআন-সুন্নাহ’র যাবতীয় আদেশ-নিষেধের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেই প্রকৃত মুসলিম হন। আর এ আত্মসমর্পণেই রয়েছে প্রকৃত কল্যাণ। মানুষের জীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও ইহলৌকিক-সব সমস্যার সমাধান রয়েছে আল্লাহ ও তার প্রেরিত মহাপুরুষ নবী মুহাম্মদ স. এর জীবনীতে। ইসলামি আদর্শ ও জীবনবিধান যথার্থ অনুসরণের মাঝেই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিহিত। পক্ষান্তরে ইসলামি বিধানের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা ও বিরুদ্ধাচারণ সব ধরনের দুঃখ-দুর্দশা, লাঞ্ছনা ও অশান্তির মূল কারণ। পার্থিব জীবনে যারা স্রষ্টার নির্দেশিত এবং প্রিয়নবী (সা.) এর প্রদর্শিত বিধানানুসারে সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করবে, তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে চিরস্থায়ী শান্তির আবাসস্থল। যাদের জীবনধারায় ইসলামি বিধিবিধান উপেক্ষিত, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক ও লাঞ্ছনাময় দোযখের আগুন।
মানবতার মুক্তিসনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা দুই ধরনের বিধান নির্দেশ দিয়েছেনÑকতকগুলো পালনীয়, কতকগুলো বর্জনীয়। যেসব বিষয় পালনের নির্দেশ রয়েছে, তা যথার্থরূপে পালনের মধ্যে ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি নিহিত; আর যেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা থেকে বিরত থাকা ও পূর্ণরূপে বর্জন করা ইসলামের দাবি এবং একজন মুমিনের পরিচায়ক। ইসলাম শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামী শরিয়তবিরোধী অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে কঠোর বিধান আরোপ করেছে। সুখী ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামি অনুশাসন ও বিধি-বিধান মেনে চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে কুরআন ও সুন্নাহে। পক্ষান্তরে ইসলামি বিধান অস্বীকার ও বিরোধিতাকে চরম ধৃষ্টতা ও মারাত্মক গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। অন্যায়, অত্যাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, চুরি ও ডাকাতিসহ অসামাজিক সব কার্যকলাপ ইসলাম নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমরা এখন দেখে নিব সমাজের বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে ইসলামে কী কী বিধি-বিধান রয়েছে।
ইসলামে চুরির শাস্তির বিধান
সামাজিক অপরাধ সমূহের মধ্যে চুরি অন্যতম। চুরির শাস্তির বিধান সম্পর্কে আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর চোর পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক (তারা চোর সাব্যস্ত হলে) তাদের হাত কর্তন করো। এটা তাদের কৃতকর্মের ফল, আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা মায়েদা : ৩৮)। প্রথমবার চুরির কারণে ডান হাত কাটা হবে। এর পর দ্বিতীয়বার আবার চুরি করলে বাম পা, তারপর আবার যদি চুরি করে, তাহলে তাকে বন্দি করে রাখা হবে, যতক্ষণ না তওবা না করে। চুরি করা মাল যদি মজুদ থাকে, তবে তা ফেরত দেয়া ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা সুরা নিসার ২৯ নং আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’
অবৈধ যৌনাচার প্রতিরোধে ইসলাম
সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির অন্যতম প্রধান কারণ অবাধ মেলামেশা। ইসলামি বিধানে অবৈধ যৌনাচার, ব্যভিচারকে শাস্তিযোগ্য গণ্য করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সুরা বনী ইসরাইলের ৩২ নং আয়াতে বলেছেন, ‘অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না, এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ অবৈধ যৌনাচারকে ইসলামে ‘জিনা’ বলা হয়। জিনার শাস্তির বিধানে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরের ২ নং আয়াতে বলেন, ‘ব্যভিচারিণী এবং ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশত কষাঘাত করবে। আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রাভাবান্বিত না করে।’ সূরা নিসার ১৬নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে দুজন এতে লিপ্ত হবে তাদের শাসন করবে। যদি তারা তওবা করে স্বয়ং নিজেদের সংশোধন করে, তবেই তাদের রেহাই দেবে। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’
ইসলামে নেশা ও মদপানের শাস্তি
যে কোনো নেশা জাতীয় দ্রব্য ও মদপান মুসলিম উম্মাহর জন্য হারাম। এ বিধান অমান্য করে মদ্যপান করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এ অপরাধের জন্য দুই ধরনের শাস্তি রয়েছে, এক. ইহকালীন ও দুই. পরকালীন। ইসলামী ফকিহ্গণ (আইনজ্ঞ) কুরআন-হাদিসের আলোকে এর শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, মদ্যপানকারীর শাস্তি আশি দোররা বেত্রাঘাত। ইমাম মালেক (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতের সমর্থক। কুরআনের সূরা বাকারার ২১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে হয়েছে, ‘আপনাকে মদ ও জুয়ার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আপনি বলুন, সে দুটিতে কবিরাহ গুনাহ (মহাপাপ) রয়েছে এবং রয়েছে মানুষের জন্য কিছু পার্থিব উপকারও। আর এ দুটির পাপরাশি উপকার অপেক্ষা বড়।’
হত্যা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম
অন্যায়ভাবে কোনো মানুষ তথা প্রাণি হত্যা ইসলামে হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। হত্যা ও সন্ত্রাসরোধে ইসলামি বিধান অত্যন্ত কঠোর। পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদায় বলা হয়েছে, ‘নর হত্যা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে দ-িত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর গোটা মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন গোটা মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করল।’ কুরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ৩৩নং আয়াতে আরও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাদের হত্যা করো না।’ হত্যার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসায় বলেন, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মোমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার স্থান জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত। আর তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’
আধুনিক এই যন্ত্রিক পৃথিবীকে নৈতিকতা সমৃদ্ধ একটি শান্তির নিবাস বানাতে চাইলে অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। পরকালের জবাবদিহিতা এবং জাহান্নামের ভয় ছাড়া নিজের সম্পদ ও নফসের তাড়না থেকে জীবনকে অপরাধমুক্ত করে গড়ে তোলা অসম্ভব।