Type to search

দাওয়াত তাবলিগ ও মুসলিম ঐক্য / বিলাল হোসেন মাহিনী

সাহিত্য

দাওয়াত তাবলিগ ও মুসলিম ঐক্য / বিলাল হোসেন মাহিনী

দ্বীনি দাওয়াত ও তাবলিগ ইসলামের প্রচার-প্রসারের একটি বিশেষ মাধ্যম। ওয়াজ-নসিহত, জুময়া’র বয়ান, দাওয়াতের উদ্দেশ্যে লিখিত বই-পুস্তক, দাওয়াতি সংগীত এবং নসিহাত সম্বলিত অডিও-ভিডিওর মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়ে থাকে। তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতি কার্যক্রমও ইসলামি দাওয়াতের একটি চলমান প্রক্রিয়া। একজন মুসলিম নিজে যেভাবে ইসলামের সুমহান বানী সমূহ পালন করবেন ঠিক তেমনিভাবে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, আপন-পর, কাছে-দূরে, ব্যষ্টি-সমষ্টি, নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার নিকট এ মহান ঐশী বানী পৌঁছে দিবেন। পবিত্র কুরআন-হাদিসে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল স. অসংখ্য বার বিশ্ববাসীর কাছে শান্তির এ অমিয় বানী তাবলিগের মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। দাওয়াত ও তাবলিগ পরিহারকারীগণ দুনিয়া ও আখিরাতে সকল  প্রকার কল্যাণ, ও সফলতা থেকে বঞ্চিত হবেন। কেননা এ আহ্বান পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “হে রসূল! তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর, যদি না কর তাহলে তুমি তাঁর বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করলে না। মানুষের অনিষ্ট হতে আল্লাহ্ই তোমাকে রক্ষা করবেন, আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে কক্ষনো সৎপথ প্রদর্শন করবেন না।” (সুরা মায়েদা-৬৭)

দাওয়াত ও তাবলিগের পরিচয় : আরবি ‘দাওয়াহ’ বা ‘দাওয়াত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘আহ্বান’ বা ‘ডাকা’। পরিভাষায় ইসলামের সুমহান বানী মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নিকট নরম স্বরে, কোমল দিলে ও সুন্দর সুন্দর শব্দ চয়নের মাধ্যমে তুলে ধরার নাম ‘দাওয়াত’। দ্বীন প্রচারে মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. ও সাহাবায়ে কেরামের অক্লান্ত পরিশ্রমের অন্য নাম দাওয়াত। দাওয়াত ও তাবলিগ একে অপরের পরিপূরক। ‘তাবলিগ’ আরবি শব্দ। এ শব্দটি ‘বালাগুন’ ক্রিয়ামূল থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘পৌঁছে দেয়া বা পৌঁছানো’। পরিভাষায় কুরআন ও হাদিসের বানী সমাজের সকল মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়াকে বা  পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমকে ‘তাবলিগ’ বলে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ‘দাওয়াত ও তাবলিগ ’ এর বিশেষ গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন এভাবে-সূরা আলে ইমরানের ১১০নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।’ এছাড়ও পবিত্র কুরআনের সূরা হা-মীম সিজদাহ’র ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সে ব্যক্তির চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে এবং নিজেও সৎকাজ করে, আর বলে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’
দাওয়াত ও তাবলিগ উম্মতের জন্য শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রেখে যাওয়া আমানত। দাওয়াতের কাজের সঙ্গে মিশে আছে প্রিয় নবি (সা.) এর পদচিহ্ন। সাহাবায়ে কেরামের অক্লান্ত পরিশ্রমের অন্য নাম দাওয়াত। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আমাদের কাছে এ দ্বীন পৌঁছেছে। দাওয়াত ও তাবলিগ আল্লাহর নির্দেশ, নবীজির দেখানো পথ, সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত কর্মনীতি।
মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার পথে ডাকার মূলনীতি বলে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সুরা নাহল’র ১২৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান করুন হিকমত বা প্রজ্ঞা দ্বারা, সুন্দর উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে উৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে আলোচনা-বিতর্ক করুন।’ মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরান’র১০৪ নং আয়াতে বলেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি গোষ্ঠী থাকে, যারা (মানুষদের) কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম (দুনিয়া ও আখিরাতে)।’
ইজতেমার পরিচয় : আরবি ‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ একত্রিত হওয়া বা করা, অর্থৎ সববেত হওয়া। মুসলিম বিশ্বে বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মুসলিম ধর্মীয় দাওয়াতি সংগঠন ‘তাবলিগ জামায়াত’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম দা’য়ীদের (আহ্বানকারী) একত্রে সমবেত করার অনুষ্ঠানকে ‘ইজতেমা’ বলে। তবে ইজতেমা শুধু ‘তাবলিগ জামায়াতে’র ভাইদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি (ইজতেমা) এখন অন্যান্য ইসলামি দ্বীন প্রচারকেরাও দেশে-বিদেশে করছেন। মহান রাব্বুল আলামিন মুসলমানদের পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকতে আদেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান’র ১০৪ নং আয়াতে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরো ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত রাসুলুল্লাহ স. বলেন, ‘দ্বীন হলো নসিহত (কল্যাণ সাধনের জন্য উপদেশ দান)। সাহাবিরা বললেন, কার জন্য? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসুল (সা.) এর জন্য, মুসলিমদের নেতৃবর্গের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য।’ (সহীহ মুসলিম)।
মুমিনদের কোনো পরিস্থিতিতেই ঐক্য বিনিষ্ট করে বিচ্ছিন্নতার পথে যাওয়া যাবে না; বরং দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি (নেতার) আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেল এবং জামায়াত অর্থাৎ বৃহত্তর মুসলিম সমাজ ও জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলি মৃত্যুবরণ করল। (সহীহ মুসলিম)। বিদায় হজে রাসুল স. দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘উপস্থিত লোকরা যেন দ্বীনের এ দাওয়াত অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়।’ এ আহ্বানে বা নির্দেশের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদির প্রত্যেকে তাবলিগ তথা দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হয়ে যায়।
বাংলাদেশের ইজতেমা : ইজতেমা আরবি শব্দ, অর্থ হলো সম্মেলন বা সম্মিলন। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হলো বিশ্বসভা, বিশ্বসম্মেলন বা আন্তর্জাতিক সমাবেশ তথা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স। এর আরবি হলো আল ইজতিমা আল আলামি, আল ইজতিমা আদদুওয়ালি, আল ইজতিমাউ বাইনাল মিলালি। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামের দুটি শব্দের প্রথমটি বাংলা, দ্বিতীয়টি আরবি শব্দ; যা উর্দু, ফারসি, হিন্দিতেও ব্যবহৃত হয়। সব মিলে ‘বিশ্ব ইজতেমা’ পরিভাষাটি বর্তমানে বাংলা রূপ লাভ করেছে। পরিভাষায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হলো দেওবন্দি ঘরানার অন্তর্গত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রবর্তিত ‘কালেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাছহিহে নিয়াত ও তাবলিগ’-এই ছয় মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত ‘তাহরিকুছ ছলাত’ বা ‘নামাজ আন্দোলন’ নামে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি কর্মধারার তিন দিনব্যাপী বার্ষিক কর্মশালা বা সমাবেশ, যা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগতীরে প্রতিবছর সাধারণত জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমানে এতে বিশ্বের ১৩৫টির অধিক দেশের মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এতে লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে এখানে বিশ্বের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ইজতেমার আগে ১০ দিনের জোড় হয়ে থাকে।
হাদিস শরিফে রয়েছে: ‘দোয়া ইবাদতের মগজ বা মূল।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ বিশেষ সময়ে এবং কোনো কাজের শুরুতে ও শেষে দোয়া করা সুন্নত। কোনো মজলিশে কোনো একজনের দোয়া কবুল হলে তাঁর সৌজন্যে আল্লাহ তা’আলা সবার দোয়া কবুল করবেন, আশা করা যায়। বড় মজমায় বা অধিক লোকের মাঝে এক বা একাধিক আল্লাহর মকবুল বা পেয়ারা বান্দা থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তবে নির্ধারিত ইবাদত, যথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সর্বাধিক এবং এগুলো সর্বাগ্রে পালনীয়। অনির্ধারিত ইবাদত নফল ও মুস্তাহাবের স্থান ফরজ-ওয়াজিবের পরে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত বাদ দিয়ে নফল বা মুস্তাহাব আমল করা জ্ঞানবানদের জন্য যুক্তিযুক্ত নয়, ইসলামে আহ্বানও নয়।মহান রব্বুল আলামিন মুসলিম স্কলার, আলিম-ওলামা, পীর-মাশায়েখসহ দ্বীনের দায়ীদের জন্য দাওয়াতের এই মেহনতকে কবুল করুন। আমিন।

বিলাল হোসেন মাহিনী
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাস, যশোর।
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।

[email protected]