Type to search

চৌগাছায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভর্তুকি মূল্যের সার

জাতীয় যশোর

চৌগাছায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভর্তুকি মূল্যের সার

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি: যশোরের চৌগাছায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কৃষকদের সার ক্রয়ে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রইচ উদ্দিন বলছেন উপজেলায় সারের কোন সংকট নেই এবং বেশি মূল্যে সার বিক্রির সুনির্দ্দিষ্ট কোন অভিযোগ তারা পাননি। পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে কৃষি অফিসেরই একটি সূত্র জানিয়েছে সার উত্তোলন না করার অভিযোগে চৌগাছা শহরের ডিলার মেসার্স শয়ন ট্রেডার্সের বিক্রয় কেন্দ্র চারদিন বন্ধ করে দেয় কৃষি অফিস। সূত্রমতে সারের নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত দাম ও কৃত্রিম সার সংকট ঠেকাতে গত ১২ আগস্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সারের বাজার মনিটরিং করার জন্য জোর তাগিদ দিয়ে একটি পত্র দেয়া হয়। এরপরই কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে মনিটরিং জোরদার করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ উপেক্ষা করে ২০০৮-০৯ অর্থ বছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত পাঁচ দফা সারের দাম কমিয়েছে সরকার। এভাবে কমিয়ে ৮০ টাকার টিএসপি ২২ টাকায়, ৭০ টাকার এমওপি ১৫ টাকায় এবং ৯০ টাকার ডিএপি ১৬ টাকায় কৃষক পর্যায়ে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি সার কৃষক পর্যায় থেকে ২টাকা কমে বিতরণ হচ্ছে। এই নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের নিকট পৌছাতে গত ১২ বছরে শুধু সারে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ডিএপি সারের মূল্য কমিয়ে ২৫ টাকা থেকে ১৬ টাকা কেজি করা হয়। এতে সরকারের বছরে ডিএপি সারে বাড়তি প্রণোদনা দিতে হবে ৮০০ কোটি টাকা।
তবে ডিলারদের কারসাজির কারনে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রণোদনার সূফল সম্পূর্ণ পাচ্ছেন না উপজেলার কৃষকরা। চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে টিএসপি সার নির্ধারিত ২২ টাকা মূল্যে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ২৮ থেকে ৩২ টাকা কেজি পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ডিএপি ১৬ টাকার স্থলে ২০ থেকে ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকার স্থলে ১৮ থেকে ২০ টাকা, ইউরিয়া ১৬ টাকার স্থলে ১৮ থেকে ২০টাকা করে কিনতে হচ্ছে তাদের। সরেজমিনে উপজেলার চৌগাছা, সলুয়া, সিংহঝুলি, পুড়াপাড়া, মাশিলা, হাকিমপুর, পাশাপোল, নারায়ণপুর, চাঁদপাড়াসহ বিভিন্ন বাজারে ঘুরে বেশি দামে সার বিক্রির সত্যতা মিলেছে। এসময় ডিলাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেন কৃষক ও খুচরা বিক্রেতারা।
উপজেলার চাঁদপাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম জানান তিনি গত সপ্তাহে গ্রামের বাজার থেকে নিজের মাছের ঘেরের জন্য ১ বস্তা টিএসপি সার ক্রয় করেন। বিক্রেতা তাকে জানান বাকিতে নিলে ১৫শ ৪০ টাকা বস্তা, আর নগদে নিলে ১৫শ টাকা বস্তা। পরে তিনি বাকিতে ১৫শ ৪০ টাকায় একবস্তা সার ক্রয়ে বাধ্য হন।
খড়িঞ্চা গ্রামের চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন তিনি ২ বিঘা আমনের চাষ করেছেন। এছাড়া সবজির আবাদ রয়েছে। তার দাবি সারা বছরই টিএসপি ২৫ টাকা কেজি, ডিএপি ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজি এবং ইউরিয়া ১৮ থেকে ১৯ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। আগস্ট মাসেও তিনি এই দামে সার কিনেছেন।
বাঘারদাড়ি গ্রামের মিজানুর রহমান জানান তিনি একবিঘার কম জমিতে আমন করেছেন। প্রায় দুই বিঘা জমিতে সবজি (পটল, করলা, ঝাল ইত্যাদি) চাষ রয়েছে তার। ৫ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন সারা বছরই টিএসপি সার ২৫ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। গত সপ্তাহেও একবস্তা টিএসপি সার কিনেছি ২৫ টাকা কেজি দরে। তবে এখন দাম আরো বেশি। টিএসপি ২৮ থেকে ৩০ টাকা কেজিও বিক্রি হচ্ছে। তিনিও বলেন সারা বছরই ডিএপি ১৮ থেকে ২০ টাকা, ইউরিয়া ১৮ থেকে ২০ টাকা, টিএসপি ২৫ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করলে তিনি এ কথাই বলবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন অবশ্যই বলতে পারবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন বিসিআইসি নির্ধারিত সার ডিলাররা সারের বরাদ্দ নেই অযুহাতে সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে চাষিদের অতিরিক্ত মূল্যে সার ক্রয় করতে হচ্ছে। তিনি বলেন টিএসপি সার আগে ডিলারদের কাছ থেকে তারা ক্রয় করতেন ১১৪০ টাকা বস্তা। অর্থাৎ প্রায় ২৩ টাকা কেজি। তারা বিক্রি করতেন ২৪/২৫ টাকা কেজি। এখন তাদের ১৪৫০ টাকা পর্যন্ত বস্তা (৫০ কেজি) কিনতে হচ্ছে। ফলে গ্রামের চাষিদের সর্বোচ্চ ১৬শ টাকা পর্যন্ত বস্তা প্রতি টিএসপি কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ইউরিয়া সার তারা ৭৯০ টাকা, ডিএপি ৮৫০ টাকা পর্যন্ত কিনছেন। তিনি বলেন বেশিরভাগ ডিলার চট্রগ্রাম থেকে বিসিআইসির বরাদ্দের সার উত্তোলন করে সেখানেই কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে দেন। সার না এনে তারা বলেন বরাদ্দ নেই। বিএডিসির বরাদ্দের সারও যশোর থেকে না এনে সেখানেই বিক্রি করে দেন। একইভাবে ভর্তুকি মূল্যে আমদানি করা সারেরও সংকট তৈরি করে বেশি দামে কিনতে বাধ্য করেন। তিনি বলেন ডিলাররা সার না এনে কাগজ বিক্রি করে দেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন সার না এনেও ডিলাররা কিভাবে অ্যারাইভাল (আগমনি বার্তা) জমা দিয়ে, কেউ আবার না দিয়েও পার পেয়ে যান?
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিসিআইসি ডিলারের সহোদর ও খুচরা বিক্রেতা জানান এবছর সার বিক্রিতে বেশ লাভ হচ্ছে। তিনি জানান টিএসপি ২৭/২৮ টাকা, ডিএপি ১৮/২০, ইউরিয়া ১৮/২০ এমওপি ১৮/২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন তিনিসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা। সার সংকট কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন জুলাই-আগস্ট মাসে সারের বরাদ্দ নেই। তাই বাইরের সার কিনে এনে বিক্রি করায় দাম বেশি। তাকে জানানো হয় জুলাই মাসে ১৫০ মেট্রিকটন টিএসপি এবং ৪০০ মেট্রিকটন ডিএপি চৌগাছার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। তখন তিনি বলেন ডিলাররা চট্রগ্রাম থেকে সার তুলে সেখানেই ১২০/১৩০ টাকা বস্তাপ্রতি বেশি দামে বিক্রি করে দিয়ে আসেন। একইভাবে বিএডিসির বরাদ্দের সারও বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলাররা যশোরেই বিক্রি করে দেন। ফলে বাজারে সার সংকট হয়।
বাজারে সার সংকট কেন জানতে চাইলে উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়নের বিসিআইসি ডিলার মেসার্স দিপু এন্টার প্রাইজের সত্বাধিকারী শাহাবুদ্দিন চুন্নু বড় মিয়া প্রথমে বলেন এই দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) মাসে টিএসপি সারের কোন বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ নেই? প্রশ্ন ফের করলে তিনি বলেন অল্প কিছু সার বরাদ্দ আছে। যা আনতে খরচ অনেক বেশি হবে বলে সার উত্তোলন করা হয়নি।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামও প্রথমে বলেন সারের বরাদ্দ না থাকায় সার সংকট হয়েছে। পরে জুলাই ও আগস্ট মাসের সার বরাদ্দ তালিকা দেখালে তিনি স্বীকার করেন বরাদ্দ আছে। তবে খরচ বেশি হওয়ায় ডিলাররা সার আনেন নি। তিনি বলেন আশেপাশের উপজেলাগুলিতেও একই অবস্থা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে চৌগাছা উপজেলায় জুলাই/২০২০ মাসে সারের চাহিদা ছিল ইউরিয়া ১৪শ মেট্রিকটন, টিএসপি ২২৫, ডিএপি ৬শ, এমওপি ১১শ, জিপসাম ৬শ ও বোরন ৮ মেট্রিকটন। এর বিপরীতে ইউরিয়া বরাদ্দ ছিল ৯৬০ মেট্রিকটন। ভুর্ত্তকির আওতাভুক্ত হিসেবে টিএসপি বিসিআইসি থেকে ৫৯ এবং বিএডিসি থেকে ৯১ মোট ১৫০ মেট্রিকটন, বিএডিসি থেকে ডিএপি ৪শ মেট্রিকটন এবং এমওপি ৩০০ মেট্রিক টন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নিয়ম রয়েছে যে মাসের সার বরাদ্দ হবে ওই মাসসহ দুই মাসের মধ্যে সেই সার সংশ্লিষ্ট উপজেলার ডিলারদের নির্ধারিত গুদামে সার তুলে উপজেলা কৃষি অফিসে অ্যারাইভাল রিপোর্ট (আগমনি বার্তা, অ্যারাইভাল রিপোর্টকেই সার উত্তোলন করে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় আনার প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়) জমা দিতে হবে। এরপর উপজেলা কৃষি অফিসার বা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার নিজে গিয়ে সার গুণে দেখে বিক্রয়ের অনুমতি দেবেন।
তবে বরাদ্দের দুইমাস ৬ দিন পার হলেও সোমবার পর্যন্ত বিএডিসির বরাদ্দ ৯১ মেট্রিকটন টিএসপির বিপরীতে ৩৭ জন ডিলারের মধ্যে ১৩ জন ৩৯.৪৫ মেট্রিকটনের অ্যারাইভাল (আগমনী বার্তা) জমা দিয়েছেন। বিসিআইসি’র বরাদ্দ ৫৯ মেট্রিকটন টিএসপির বিপরীতে ১৬ ডিলারের ১৪ ডিলার ৫৫.৩৫ মেট্রিকটনের অ্যারাইভাল (আগমনী বার্তা) জমা দিয়েছেন। তবে বিসিআইসি ডিলাররা এসব আগমনি বার্তা জমা দিলেও সার এলাকায় আনেননি বলে খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকদের অভিযোগ।
এছাড়া বিএডিসি থেকে বরাদ্দ ৪শ মেট্রিকটন ডিএপি সারের বিপরীতে উপজেলার ৩৭ জন ডিলারের মধ্যে সোমবার পর্যন্ত ২৩ জন ডিলার মোট ২৯৩.৫৫ মেট্রিকটন ডিএপি সারের অ্যারাইভাল (আগমনি বার্তা) জমা দিয়েছেন।

Tags:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *