চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি
যশোরের চৌগাছার শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বাংলা সনের ভাদ্রমাসের শেষ মঙ্গলবার থেকে এই মেলা শুরু হলেও করোনা ভাইরাসের কারনে গত বছর মেলার অনুমতি দেয়া হয়নি। তবে তিন দিনের জন্য ঔরসের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো।
চলতি বছর মেলার অনুমোদন নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন মেলা কমিটির নেতৃত্বস্থানীয়রা। যদিও এরই মধ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেলা ও ঔরসের অনুমতি চেয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলন।
নারায়নপুর ইউনিয়ন পরিষদের হাজরাখানা ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলন বলেন, অন্যান্য বছরগুলোতে প্রথমে স্থানীয় সংসদ সদস্য মেলা কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি জেলা প্রশাসকের কছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। একইভাবে ঔরসের জন্য বলুহ দেওয়ান (রহ) মাজারের খাদেম জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে মেলার অনুমতি দেন। বিগত বছরগুলিতে এ অনুমতি ৩ থেকে ১৫ দিনেরও হয়েছে।
তিনি বলেন করোনা ভাইরাসের কারনে গত বছর মেলার অনুমতি দেয়া হয়নি। এ বছরও দোলাচলে রয়েছি। মেলায় দোকান দিতে আসা কিছু ব্যবসায়ী এরই মধ্যে এসে গেছেন। অন্যরা যোগাযোগ করলেও তাঁদের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছিনা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মেলা পরিচালনা কমিটি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রতি বাংলা সনের শেষ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। তবে আসবাবপত্রসহ অন্যান্য দ্রব্যাদির বেচাকেনা শুরু হয়ে যায় আরও আগে থেকে।
শুক্রবার সরেজমিনে মেলাস্থলে গেলে দেখা যায় নওগাঁ জেলা থেকে খেলনা ব্যবসায়ীরা এসেছেন। সামগ্রী ঢেকে রেখে শুধাংশু রায়, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল মাজেদ, মোঃ পিন্টু ও সাদ্দাম হোসেন পাশে বসে আছেন। তাঁরা জানান, মেলায় এসেছেন। তবে এখন মেলা হবে কিনা জানেন না। চিন্তিত ব্যবসায়ীরা জানান, এই মালামাল যে নিয়ে ফিরে যাবো সেই ভাড়ার টাকাও নেই। তিনদিন ধরে এখানে বসে বসেই খাচ্ছি।
মেলার অন্যকোনে মাজারের পাশে গিয়ে দেখা যায় আরও কয়েকজন খেলনা ব্যবসায়ীকে। সেখানে খেলনা ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান জানান, ‘এবার হয়ত মেলা হবে না। তিনি জানান তিনিসহ অনেক ব্যবসায়ীই এসেছেন নওগাঁ থেকে। অন্যরা বৃহস্পতিবার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বারোবাজারে গাজী-কালু-চম্পাবতীর মেলায় গেছেন।’
দেখা যায়, ঔরস করার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। মাজার রংচং করা হয়েছে। মাইক সাউন্ডবক্স আনা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে চিশতিয়া তরিকার গুরুরা এসেছেন।
মাজার কমিটির সভাপতি আশাদুল ইসলাম বলেন, মেলার অনুমতি না হলেও গতবছর ঔরসের অনুমতি পেয়েছিলাম। আশা করছি এবারো অনুমতি পাবো।
প্রতি বাংলাসনের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) রওজা শরীফকে ঘিরে বসে এই মেলা। কপোতাক্ষ নদের পাশে উঁচু ঢিবির ওপর বলুহ দেওয়ানের (রহ) রওজা অবস্থিত। মেলার সময়ে হাজরাখানাসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পড়ে ব্যস্ততার ধুম। এ অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে ঈদে-পূজায় না হলেও মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই দাওয়াত করার রেওয়াজ রয়েছে। যাকে ঘিরে এই মেলা তার সম্পর্কে রয়েছে নানা মিথ। লোক মুখে প্রকাশ পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ‘তিনি যা বলতেন তাই হতো।’ তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তিনি একই উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জেষ্ঠ ভক্তদের মতে ‘তিনি ৩-৪ শ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।’
তবে জেষ্ঠ সাংবাদিক নাসির হেলালের লেখা ‘যশোর জেলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার’ এবং সাংবাদিক মাসুদ পারভেজের লেখা ‘চৌগাছার পীর-দরবেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আনুমানিক ষোড়’শ শতাব্দির প্রথমদিকে তিনি জন্মগ্রহন করেন। গ্রন্থদুটি থেকে জানা যায় বলুহ (রহ) এর নামে ভারতের কলকাতা ও নদীয়া, বাংলাদেশের চৌগাছার হাজরাখানাসহ বিভিন্ন স্থানে ৫২টি থান (ইবাদতগাহ) আছে। যেখানে তার ভক্তরা বসে ইবাদত-বন্দেগি করেন। বর্তমানে উপজেলার জিওলগাড়ি, পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়-ধোপাধী গ্রামে তার থানে ছোট পরিসরে মেলা বসে থাকে। তার নামে চৌগাছার হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) দাখিল মাদরাসার নামকরণ করা হয়েছে।
পীর বলুহ (রহ) সম্পর্কে মিথ প্রচলিত আছে, ‘যখন তাঁর বয়স ১০/১২ বছর তখন পিতার নির্দেশে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেতের মালিক গরুগুলি ধরতে গেলে তিনি সব গরু বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।’ পিতার মৃত্যুর পর তিনি উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুর খাটতেন। একদিন সরিষা মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে সরিষার গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখে সরিষার গাঁদায় আগুন জ্বলছে। তখন গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হেঁসে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন শরিষা পোড়েনি।’ ‘একদিন তার মামি খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুনে জ্বাল দিতে থাকেন। এতেও তাঁর পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি।’ এমন অনেক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ তাঁর নিকট এসে শিষ্যত্ব নেন। ‘অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান।’
তার মৃত্যুর পর গ্রামাঞ্চলের মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে তাঁর নামে মানত করতে থাকে। মানত পরিশোধে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখানা গ্রামে অবস্থিত তাঁর রওজা শরীফে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নারকেল ও টাকাসহ নানা দ্রব্যাদি দিয়ে মানত শোধ করতে থাকে। সেখান থেকেই একসময় ভক্তদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে জমজমাট মেলা। প্রতি ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা শুরু হয়ে ৩ থেকে সাত দিন মেলার আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও মেলা শুরুর ১৫/২০ দিন পূর্ব থেকে শেষের ১০/১২ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে মেলার বেচাকেনা।
একসময় মেলায় বিশৃঙ্খলা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০০২ সালে মেলায় ব্যাপক বোমাবাজি করে সন্ত্রাসীরা। সেসময় মেলায় কয়েকজন দোকানী ও দর্শনার্থী হতাহত হয়। অন্যদিকে ২০০৯ সালে মেলাচলাকালীন চৌগাছা শহরে উপজেলা আওয়ামী লীগের অফিসে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা ও গুলিতে খুন হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সেসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুল। পরে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ায় সে পরিবেশ পাল্টে গেছে।
মেলায় সারা দেশ থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আসেন ব্যবসা করতে। এ অঞ্চলের যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার ২০/৩০ টি উপজেলার মানুষ আসেন মেলা দেখতে এবং মেলা থেকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করতে। কপোতাক্ষ নদের তীর থেকে হাজারাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত এ মেলা আয়াতন ও পরিধিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরেক বিখ্যাত সাতক্ষীরার গুড়পুকুরিয়ার মেলা থেকেও বৃহৎ।
প্রকাশক ও সম্পাদক :
মোঃ কামরুল ইসলাম
মোবাইল নং : ০১৭১০৭৮৫০৪০
Copyright © 2025 অপরাজেয় বাংলা. All rights reserved.