শ্যামল দত্ত চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি:
"স্বাদে সেরা, গন্ধে ভরা খেজুর গুড়ে মনোহরা" এই প্রবন্ধে যশোরের চৌগাছায় খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে দ্বিতীয়বারের মত উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলায় গুড়ের মেলার আয়োজন করা হয়েছে। সোমবার(২৯ জানুয়ারি) সকালে যশোরের জেলা প্রশাসক আবরাউল হাসান মজুমদার এই মেলার উদ্বোধন করেন। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় গাছিদের নিয়ে ২৯ জানুয়ারি সোমবার থেকে ৩১ জানুয়ারি বুধবার পর্যন্ত উপজেলা চত্বরে তিন দিনব্যাপী এই গুড়ের মেলা অনুষ্ঠিত হবে।
জেলা প্রশাসক আবরাউল হাসান মজুমদার প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন, যশোরের ব্রান্ডপণ্য খেজুর রসের গুড় জাতীয় অর্থনীতির একটি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন যশোরের জেলা প্রশাসক আবরাউল হাসান মজুমদার । তিনি বলেন, খেজুর গাছ প্রস্তুত থেকে শুরু করে রস সংগ্রহ ও গুড় পাটালি তৈরির কাজে যদি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা যায়, তাহলে কাজটি আরো সহজ হবে। গাছ প্রস্তুত থেকে গুড় তৈরি পর্যন্ত যে ধাপ গুলো রয়েছে তা যশোরে ঐতিহ্যবাহি প্রসিদ্ধ একটি শিল্প। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে খেজুর গাছ রক্ষার বিকল্প নেই। গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উপজেলার সকল রাস্তা, নদীর ধার ও খাস জমিতে খেজুর গাছ রোপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গত বছর উপজেলায় ৫০ লাখ খেজুর গাছের চারা রোপন করা হয়েছে। সে গুলো রক্ষানাবেক্ষণের দায়িত্ব এই উপজেলার মানুষের।
তিনি আরও বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারলে এই পেশা কষ্টসাধ্য থাকবেনা। গাছ প্রস্তুত ও রস সংগ্রহের কাজ সহজ হলে চাষীরা এই এই পেশা থেকে সরে যাবেনা বরং অন্যরা আগ্রহী হবে।
তিনি আরো বলেন, খাঁটি গুড় তৈরি করতে পারলে দেশ বিদেশে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে যারা এই পেশায় জড়িত রয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে তাদের পাশে দাড়াতে হবে।
উপজেলা চত্বরে বৈশাখী মঞ্চে অনুষ্ঠিত গুড় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা। উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মেহেদী হাসান সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন,স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট কলামিষ্ট মিজানুর রহমান মধু, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ড.মোস্তানিছুর রহমান, পৌর মেয়র নুর উদ্দীন আল মামুন হিমেল, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূ‚মি) গুঞ্জন বিশ্বাস, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুশাব্বির হোসাইন,সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম,ফুলসারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি মাসুূদ চৌধুরী প্রমুখ। এসময় উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ১১ টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ,সংবাদকর্মী, স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহ গাছিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের অন্যান্য বক্তারা বলেন, যশোরের খেঁজুর রস ও গুড়ের ঐতিহ্য শতশত বছরের পুরাতন। যশোর জেলা ধরেই খেঁজুরের রস গুড় উৎপাদিত হলেও রস গুড় উৎপাদনে চৌগাছার রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট। তৎকালিন বৃটিশ ভারতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজরা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ধোবা নামক স্থানে চিনির কল প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু ক্ষতির মুখে কোম্পানী বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ঐ সময়ই কলকাতার গ্লাডস্টোন উইলি অ্যান্ড কোং চৌগাছায় এসে চিনির কল স্থাপন করেন। একই সময় ১৮৬১ সালে নিউ হাউজ সাহেব ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদের সঙ্গমস্থল চৌগাছার তাহেরপুরে একটি চিনির কল স্থাপন করেন। পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলে শতশত চিনির কল প্রতিষ্ঠিত হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোস্পানী ইউরোপে চিনি রপ্তানী শুরু করে। কালের বিবর্তনে যশোর জেলাসহ চৌগাছার খেঁজুর গুড়ের ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। খেঁজুর গুড়ের সেই পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে দেশি ও আর্ন্তজাতিক বাজারে গুড়ের চাহিদা বাড়াতে উপজেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় বক্তারা।
মেলায় গাছিরা তাদের উৎপাদিত নির্ভেজাল গুড় বিক্রির জন্য হাজির হয়েছেন। উপজেলার সুখপুরিয়া ইউনিয়নের বর্ণি গ্রামের রমজান তরফদারের ছেলে মহিদুল ইসলাম, একই এলাকার গাছি বাবলুর রহমান, জগদিশপুর ইউনিয়নের স্বর্পরাজ গ্রামের গাছি ইসমাইল হোসেনসহ কয়েকজন জানান, তারা খাটি গুড় নিয়ে মেলায় এসেছেন। মেলার এই তিনদিনে লাখ টাকার গুড় বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন। এছাড়া মেলায় খেজুর গুড়ের তৈরি বিভিন্ন পিঠার স্টলও রয়েছে।
মেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল রস জ্বালানোর পাত্র তাপাল থেকে খেঁজুর গাছের পাতা দিয়ে গরম গরম গুড় খাওয়া । এ গুড় খেতে গিয়ে আগত দর্শনাথীরা যেন নস্টালোজিয়ায় ডুবে যান। গুড় খেতে খেতে অনেকে বলেন সেই শৈশবে আর কৈশরের দিনগুলিতে জালই (মাটির তৈরী পাত্র) আর তাপাল (টিনের তৈরী পাত্র) থেকে খেঁজুর পাতা দিয়ে গরম গরম গুড় খেয়েছি আজ আবার খেলাম।
গুড়ের মেলার যে নয়নাভিরাম দৃশ্য সবার নজর কাড়ে সেটা ছিল ঐতিহ্যপ্রেমীদের জমপেশ আড্ডা। এই ঐতিহ্যপ্রেমীরা তাদের সকল কাজ ফেলে রেখে মেলার মাঠে দাড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করেন। এদিকে দর্শনার্থীদের কাছে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে সংবাদকর্মীরা। মেলায় কথা হয় চৌগাছা যশোর জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলামসহ কয়েকজনের সাথে তারা সবাই বলেন ব্যতিক্রমী এ মেলায় এসে খুব ভাল লাগছে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে এ ধরনের মেলার আয়োজন করা হলে ভাল লাগবে।
গাছীরা জানান, খেঁজুর গাছ নিধন বন্ধ করলে গুড় উৎপাদন বাড়বে। এছাড়া প্রতিবছর অন্যান্য গাছের সাথে খেঁজুর গাছ রোপন করার জন্য সরকারী সহায়তা করা প্রয়োজন।
প্রকাশক ও সম্পাদক :
মোঃ কামরুল ইসলাম
মোবাইল নং : ০১৭১০৭৮৫০৪০
Copyright © 2025 অপরাজেয় বাংলা. All rights reserved.