চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী (১০ অক্টোবর)

নড়াইল প্রতিনিধি
সোমবার (১০ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্রশিল্পী এস এম
সুলতানের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে দিনবাপি জেলা প্রশাসন শিল্পকলা
একাডেমীর আয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে শিল্পীর কবরে
পুষ্পস্তবক অর্পণ ও জিয়ারত,চিত্রা নদীতে শিশুদের নৌকা ভ্রমন, শিশুদের
অংকিত চিত্র প্রদর্শনী, বিশিষ্ট শিল্পীদেও চিত্র প্রদর্শনী, শিশুদের
অংশগ্রহনে আর্টক্যাম্প, শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর তথ্যচিত্র উপস্থাপন,
প্রামান্য চিত্র প্রদর্শন (আদম সূরাত), শিশুদের নাট্য বিষয়ক কর্মশালা এবং
বাউল গানের আসর। দিনব্যাপি এসব অনুষ্ঠান শিশুস্বর্গ মিলনায়তন, নড়াইল
শিল্পকলা একাডেমী অডিটোরিয়াম এবং শিল্পী সুলতানের হাতে গড়া লাল বউিল
সম্প্রদায় চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে।
জানা যায়, লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সুলতান নড়াইল জমিদার বাড়িতে বিভিন্ন
নকসার কাজে রাজমিস্ত্রী বাবাকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে চিত্রকলার প্রতি
আকৃষ্ট হন। এশবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী
নড়াইলে আসেন। এ সময় তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় গেটে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষনিকভাবে
কাগজে তাঁর ছবি এঁকে ফেলেন শিশু সুলতান। রাশভারী উপাচার্য নিজের সুন্দর
ছবি দেখে তার পিঠ চাটড়ে বললেন “সাবাস”। এভাবে নড়াইলের তৎকালিন জমিদার
ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সুদৃষ্টিতে পড়েন। পরে নড়াইলের জমিদারদের প্রভাবে
খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও শিল্প-সমালোচক কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির
সদস্য অধ্যাপক সায়েদ সোহরাওয়ার্দির বিশেষ অনুরোধে ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট
স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সুলতান নিজেকে প্রথাগত শিক্ষায় নিয়োজিত রাখতে
পারেন নি। ১৯৪৪ সালে তিনি কলেজ ছেড়ে চলে যান কাশ্মীরের পাহাড়ি অঞ্চলে।
সেখানে উপজাতীয়দের সঙ্গে বসবাস ও তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে চিত্রাংকন শুরু
করেন। এরপর শুরু হয় শিল্পীর খ্যাতিময় জীবন। ১৯৪৭ সালে ভারতের সিমলায় তার
প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ
প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালনী বিশ্ববিখ্যাত চিত্র শিল্পী পাবলো পিকাসো,
ডুফি, সালভেদর দালি, পলক্লী, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়।
১৯৫১ সালে নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের
প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৫ সালে সবার অলক্ষে করাচি থেকে তিনি ঢাকায় চলে
আসেন। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্কুল অব আর্টস।
সুলতানের শিল্পকর্মের বিষয় ছিল বাংলার কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার,
মাঠ, নদী, হাওর, বাঁওড়, জঙ্গল, সবুজ প্রান্তর ইত্যাদি। চিত্রাঙ্কনের
পাশাপাশি বাঁশি বাজাতে পটু ছিলেন। পুষতেন সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ,
মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন প্রাণি।
সৃষ্টিশীল এই শিল্পী নড়াইলের পুরুলিয়ায় ১৯৫৫-৫৬ সালে ‘নন্দন কানন ফাইন
আর্ট এন্ড স্কুল, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে যশোর এম.এম কলেজের একটি পুরোনো
হোষ্টেলে একাডেমী অব ফাইন আর্ট স্কুল, ১৯৭৮ সালের দিকে জন্মস্থান নড়াইলের
মাছিমদিয়ায় ফাইন আর্ট স্কুল এবং ১৯৮৭ সালে নড়াইলের কুরিগ্রামে
“শিশুস্বর্গ” নামে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি শিশুদের খুব
ভালোবাসতেন। তাদের জন্য তৈরী করেন বড় বজরা (ইঞ্জিন চালিত নৌকা)। তাঁর আশা
ছিল শিশুদের সাথে প্রকৃতিকে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে এই বজরায় করে চিত্রা নদীতে
শিশুদের নিয়ে ছবি আঁকবেন । কয়েকবার তিনি শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে ঘুরে
ছবি আঁকানো শিখিয়েছেন। ১৯৯৩ সালের ১০ আগষ্ট শিল্পী নিজ উদ্যোগে
চিত্রাংকন, নৃত্য ও সঙ্গীত শিক্ষার জন্য ‘লাল বাউল সম্প্রদায়’ নামে একটি
সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ২০০৩ সালে শহরের কুড়িগ্রামে সরকার শিল্পীর
নামে সুলতান কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে। বর্তমানে নড়াইলের সুলতান কমপ্লেক্সে
তাঁর আঁকা ২২টি ছবি রয়েছে। তবে ছবিগুলি সঠিক পরিচর্যার অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ
হচ্ছে। ২০০৯ সালে শিল্পীর ভক্তরা সুলতানের বাগান বাড়ি শহরের পশ্চিম
মাছিমদিয়ায় ‘এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়’প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চিত্রশিল্পের খ্যাতি হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য
ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’
এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া
১৯৮২ সালে একুশে পদকসহ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ১৯৮৪ সালে
বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ
চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা।
এসএম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা
মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত
সামরিক হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বরেণ্য এই
শিল্পীকে নড়াইলের কুড়িগ্রামে শায়িত করা হয়।