
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও বিশ্বনবী সা. এর হাদিস থেকে জানা যায়, সমাজে অন্যায়-অনাচার বেড়ে গেলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে বেশি। রাসুল সা. দোয়া করেতেন যেনো তার উম্মতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে এক সঙ্গে ধ্বংস না করা হয়। কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে রাসুল সা. বিচলিত হয়ে পড়তেন। আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন। বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতেন এবং অন্যদেরও তা করার নির্দেশ দিতেন। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে তিনি মসজিদে চলে যেতেন এবং নফল নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন। রাসুল সা.-এর এই আমল থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী তা জানতে পারি। আমাদের উচিত নিজেদের আমল-আখলাক বিশুদ্ধ করে খাঁটি মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেহেতু মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়, অগণিত মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসাও একটি মহৎ কাজ। যে কোনো দুর্যোগের মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। মানুষ মানুষের জন্য এই নীতি প্রয়োগের উৎকৃষ্ট সময় হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্ত। ঝড়-বৃষ্টি, টর্নেডো-জলোচ্ছ্বাস, খরা-বন্যা প্রতিটি দুর্যোগেই মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রকৃত মুমিনের পরিচয়। আল্লাহ কারো সামর্থ্য দেখেন না, তিনি দেখেন আন্তরিকতা। মানুষের জন্য কিছু করার মানসিকতা থাকলে এর সুফল আল্লাহর কাছ থেকে অবশ্যই পাওয়া যাবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবনের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। হে নবি! ধৈর্যধারণকারীদের আপনি সুসংবাদ দিন যখন তারা বিপদ পড়ে তখন বলে নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাবো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫ ও ১৫৬) প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসমান থেকেও আসতে পারে আবার মাটির নি¤œভাগ হতেও আসতে পারে। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৬৫)
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে তিনি তাদের তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। ’ (সুরা রোম, আয়াত : ৪১) অর্থাৎ স্থলে, জলে তথা সারা বিশ্বে মানুষের নাফরমানির বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। বিপর্যয় অনেক রকমের হতে পারে। যেমন : দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অগ্নিকা-, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলির প্রাচুর্য, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি আপদ-বিপদ বোঝানো হয়েছে। (ইমাম কুরতুবি, বাগভি)
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ উপস্থাপনে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য- ভারসাম্যহীন পরিবেশের কারণেই জলবায়ুর এই নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। সুন্দর প্রকৃতিকে কে ধ্বংস করছে? আসুন খুঁজে দেখি পরিবেশের জন্য আল্লাহ নেয়ামত সমূহ’র কয়েকটি। পরিবেশকে মানুষের উপযোগী করার জন্যই পৃথিবীতে পানির সৃষ্টি। তাই তো কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। এই পানি থেকে তোমরা পান কর এবং এ থেকেই উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, যাতে তোমাদের পশুচারণ কর। এ পানি থেকে তোমাদের জন্য চাষ করেন ফসল, জয়তুন, খেজুর, আঙুর ও সব ধরনের ফল। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নাহল : ১০-১১)।
আজকের বিজ্ঞানও এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি অতুলনীয়। অথচ এই পানি কতোভাবে দূষিত করছি আমরা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি প্রধান কারণ পানি দূষণ। বিশুদ্ধ পানি অপচয়ের ফলে যেমন বিশুদ্ধ পানির সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে, অন্যদিকে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে পানি দূষণে পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। হাদিসে এসেছে, নবীজি সা. একবার হজরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সা’দ তখন অজু করছিলেন। নবীজি তাকে বললেন, এ কেমন অপচয়? সা’দ জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসুল! ওজুতেও (অধিক পানি ব্যবহার করলে) অপচয় হয় কী? উত্তরে নবীজি বলেন, হ্যাঁ, তুমি যদি প্রবহমান নদীতেও ওজু করে থাক! (মুসনাদে আহমাদ : ৬৭৬৮)।
পানিতে নাপাকি ফেলা বা দূষিত করাকে নবীজি সা. অপছন্দ করতেন। অপর হাদিসে বলেছেন, ‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাক- যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২৬)। এমনিভাবে পরিবেশ রক্ষায় নবীজি অনেক পদ্ধতি শিখিয়েছেন। এসব অনুসরণ করলে জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে মানুষ।
লেখক : পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর।
bhmahini@gmail.com