Type to search

শরিয়তের দৃষ্টিতে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ও ক্রয়-বিক্রয়/বিলাল হোসেন মাহিনী

সাহিত্য

শরিয়তের দৃষ্টিতে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ও ক্রয়-বিক্রয়/বিলাল হোসেন মাহিনী

আল্লাহভীরু ও সৎ ব্যবসায়ীরা জান্নাতে নবী-রাসুলদের সাথী হবেন। ব্যবসায় সততা ও শরয়ী নির্দেশনা মেনে চললেই কেবল নবী-রাসুলদে সাথে মর্যাদাবান হবেন ব্যবসায়ীরা। কেননা, হারাম সুদের বিপরীতে মহান আল্লাহ তায়ালা ব্যবসায় ও ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসায় তথা ক্রয়-বিক্রিকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা-২৭৫)। দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি বিষয়ের মতো লেনদেন ব্যবস্থায়ও ইসলাম কিছু সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এসব নীতির ব্যতিক্রম হলে ইসলামী দৃষ্টিকোণে সেই ব্যবসায়িক চুক্তি বাতিল হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
ব্যবসায়ের মধ্যে ত্রুটিমুক্ত পণ্য ও ক্রয়-বিক্রয় সঠিক এবং বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয় আবশ্যক। যেমন : ক) চুক্তিকারী তথা ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি বা অস্তিত্ব থাকা; খ) পণ্য ও মূল্য নির্ধারণ হওয়া; গ) প্রস্তাব-গ্রহণ সম্পন্ন হওয়া; ঘ) ক্রয়-বিক্রয় উভয়ের সম্মতিতে হওয়া; ঙ) ক্রেতা-বিক্রেতা ক্রয়-বিক্রয়ের উপযুক্ত হওয়া; চ) বিক্রেতার জন্য পণ্যের মালিকানা বা প্রতিনিধিত্ব থাকা; ছ) পণ্য মূল্যমান হওয়া, অর্পণযোগ্য হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া পদ্ধতি, অবস্থা ও ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি চিন্তাবিদগণ আরো অনেক শর্ত ও নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। দুনিয়াতে যত প্রকারের ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয়, ইসলাম তার সবগুলোকেই বৈধতা দেয়নি। মানুষের লাভ-ক্ষতির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের পর ইসলাম কোনোটিকে বৈধ আবার কোনোটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক বৈধ ক্রয়-বিক্রয়ের কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। নিম্নে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত ইসলামী শরিয়তের মৌলিক বিধানগুলো তুলে ধরা হলো:

ক) বিক্রীত দ্রব্যের সমস্ত অবস্থা (দোষ-ত্রুটি থাকলে তাসহ) ক্রেতাকে খুলে বলতে হবে, অন্যথায় বিক্রি শুদ্ধ হবে না এবং ক্রেতার তা ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকবে। দ্রব্যের দোষ না বলে ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করা হারাম। খ) যেসব দ্রব্য বিক্রি করা হবে, তা সামনে থাকতে হবে অথবা তার নমুনা সামনে থাকতে হবে। অদেখা  দ্রব্য দেখার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার শর্তে ক্রয় করার অনুমতি আছে। গ) শরীয়তে অবৈধ বস্তু ক্রয় বা বিক্রয় করা কোনোভাবেই বৈধ নয়। কেউ কোনো কারণে অবৈধ বস্তুর মালিক হয়ে গেলেও তা অন্যের কাছে বিক্রি করা যাবে না। ঘ) বিক্রেতা দ্রব্যের যে গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছিল, পরে তার বিপরীত প্রমাণিত হয়, যেমন : বিক্রেতা বলেছিলো- রং পাকা বা অমুক কম্পানির, অথচ পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, এ ক্ষেত্রে ক্রেতা সেটা ফেরত দেওয়ার অধিকার রাখে। ঙ) দাম স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে হবে। কেউ তা অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ রাখলে বিক্রি শুদ্ধ হবে না । চ) ক্রয়ের সময় ক্রেতা যদি বলে, দুই-তিন দিনের মধ্যে (তিন দিনের বেশি নয়) দ্রব্যটি গ্রহণ বা বর্জনের কথা জানাব অথবা ঘরে দেখিয়ে পরে বলব, তাহলে ওই মেয়াদের মধ্যে ক্রেতার তা ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকবে, যদি ক্রেতা দ্রব্যটি ব্যবহার করে না থাকে কিংবা যেসব দ্রব্য ব্যবহার করা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, সেগুলো ব্যবহারের ফলে দ্রব্যটির মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি সৃষ্টি না হয়ে থাকে। ছ) বিক্রেতা যদি কোনো দ্রব্যের বিশেষ গুণাগুণ বর্ণনা করে; কিন্তু অন্ধকারের কারণে ক্রেতা ভালোভাবে দেখে নিতে না পারে কিংবা শুধু বিক্রেতার বর্ণনার ভিত্তিতে সে ক্রয় করে; কিন্তু পরে নেওয়ার পর বিক্রেতার বর্ণনামতো না পায়, তাহলে সেটা ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকবে। একইভাবে নমুনা দেখে অর্ডার করার পর নমুনামতো না পেলেও তা ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকবে। অবশ্য দ্রব্যটি ব্যবহার করলে পরে আর তা ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকবে না। জ) কোনো গ্রব্য না দেখে ক্রয় করে থাকলে দেখার পর তা রাখা বা না রাখার অধিকার থাকবে। ঝ) যেসব বস্তুর নমুনা দেখে সে সম্পর্কে অনুমান করা যায় না, সেরূপ দ্রব্যের নমুনা দেখে অর্ডার দিলে দ্রব্যটি পাওয়ার পর তা ক্রয় করার বা না করার অধিকার থাকবে। ঞ) বিক্রেতা যদি কোনো দ্রব্যের ওই পরিমাণ দাম নিয়ে থাকে, যা কোনো স্বচ্ছ নির্দোষ দ্রব্যের বিনিময়ে নেওয়া হয়ে থাকে, আর পরে তাতে কোনো দোষ প্রকাশ পায় তাহলে ক্রেতার তা ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকবে। ট) ক্রেতার হাতে এসে কোনো ত্রুটি সৃষ্টি হলে ওই দ্রব্য ফেরত দেওয়ার অধিকার নষ্ট হয়ে যায়। ঠ) ত্রুটি প্রকাশ পাওয়ার পর কিছু (ভালোটা) রেখে বাকিটা (খারাপগুলো) ফেরত দেওয়ার অধিকার নেই। রাখলে পুরোটা রাখতে হবে কিংবা পুরোটা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য বিক্রেতা সম্মত হলে সব রকম করা যেতে পারে। ড) যেসব দ্রব্য ভাঙার পর (যেমন ডিম) বা কাটার পর (যেমন তরমুজ) তার ভালো-মন্দ বোঝা যায়, সেসব দ্রব্য ভাঙা বা কাটার পর যদি সম্পূর্ণ ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থা দেখা যায়, তাহলে পুরো দাম ফেরত নেওয়ার অধিকার থাকবে। যদি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করার উপযোগী থাকে (যেমন তরমুজ বা কোনো তরকারি জন্তুকে খাওয়ানের যোগ্য থাকে) তাহলে সেগুলো ফেরত না দিলে কিছু দাম কমানোর অধিকার থাকে। ঢ) ক্রয়-বিক্রিয়ের সময় প্রথমে দাম পরিশোধ এবং পরে পণ্য হস্তান্তর হবে। ক্রেতা এরূপ দাবি করতে পারবে না যে প্রথমে পণ্য দিন ও পরে দাম দিন। ণ) বিক্রেতা কোনো দ্রব্য বিক্রি করলে ক্রেতাকে তা এমনভাবে হস্তান্তর করতে হবে, যাতে দ্রব্যটি তার আয়াত্তে নিতে কোনো ধরনের বেগ পেতে না হয়। ত) দাম পরিশোধসংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার ক্রেতাকে বহন করতে হবে, যেমন: মানি-অর্ডার খরচ পে-অর্ডার ও পোস্টাল অর্ডার খরচ ইত্যাদি। থ) ক্রয়-বিক্রিয়ের লেখালেখিসংক্রান্ত খরচ যেমন: দলিল রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ইত্যাদি ক্রেতাকে বহন করতে হবে। দ) ক্রেতাকে পণ্য বুঝিয়ে দিতে যে খরচ হয়ে থাকে সেসব খরচ বিক্রেতাকে বহন করতে হবে। যেমন: মাপ বা ওজন করার ব্যয়, সম্পত্তিসংক্রান্ত কাগজপত্র না থাকলে সেগুলো সংগ্রহের ব্যয় ইত্যাদি। ধ) ক্রেতার কাছে মালামাল পৌঁছানোর পরিবহন ব্যয়, ভিপি খরচ ইত্যাদি ক্রেতাকে বহন করতে হবে। কিন্তু বিক্রেতাকেই তা বহন করতে হবে এরূপ শর্ত আরোপ করলে বিক্রয় ফাসেদ হয়ে যাবে। ন) ইসলামী শরিয়তে যেসব ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ নয় সেরূপ কোনো কেনা-বেচা সংঘটিত হলেও তা মালিককে ফেরত দেওয়া জরুরি। কোনোভাবে তাতে হস্তক্ষেপ করা বা নিজের কাজে ব্যবহার করা যায়েজ নয়। প) ফল আসার আগে বা পরিপক্ব হওয়ার আগে আম, কাঁঠাল প্রভৃতির বাগানে বিক্রি করার যে প্রচলন আছে, তা জায়েজ নয়। ফ) যে ব্যক্তি হারাম উপায়ে কোনো সম্পদ উপার্জন করেছে তার থেকে সেটা ক্রয় করা জায়েজ নয়। (তথ্যসূত্র : ফাতাওয়া মাহমুদিয়া, চতুর্থ খ-; বেহেশতি জেওর; ইসলামী ফিকাহ, তৃতীয় খ-।) মহান আল্লাহ আমাদেরকে নবীর (সা.) এর সুন্নাত অনুযায়ী ইসলামী শরীয়াহ মেনে ব্যবসায়-বাণিজ্য করার তৌফিক দান করুন।