Type to search

রিফাত হত্যার মদদ দাতারা কি অধরাই থেকে যাবে

জাতীয়

রিফাত হত্যার মদদ দাতারা কি অধরাই থেকে যাবে

অপরাজেয় বাংলা ডেক্স-বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পেছনের মদদদাতা গডফাদাররা কি আড়ালেই থেকে যাবে- এ প্রশ্ন এখন বরগুনাবাসীর। তারা বলছেন, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতেই রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর ইতোমধ্যে রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে মামলাটি পিবিআই অথবা সিআইডিতে ন্যস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। তিনি এ দাবি জানানোর পরই নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ মামলা পিবিআই ও সিআইডিতে না দেওয়ার জন্য দাবি জানান। তিনি বরগুনা পুলিশের তদন্তেই আস্থা রাখেন। মিন্নির বাবা-মাকে গ্রেপ্তারেও বারবার দাবি জানাচ্ছেন দুলাল শরীফ।
মিন্নির বাবাসহ একাধিক সূত্রের অভিযোগ, মিন্নিকে গ্রেপ্তার, এর আগে তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, প্রথম দিন মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়ানো, মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পিবিআই ও সিআইডিতে ন্যস্ত না করতে দুলাল শরীফের দাবি, মিন্নির বাবা-মাকে গ্রেপ্তারের দাবি- সবকিছুর পেছনেই কলকাঠি নাড়ছেন বরগুনার স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ। সুনাম দেবনাথ বরগুনার মাদকচক্রের গডফাদার হিসেবে ভূমিকা রাখছেন বলে একাধিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। স্থানীয় লোকজনও একই অভিযোগ করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ এমপিপুত্র এবং আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। বরগুনার সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
বরগুনায় ইয়াবা ব্যবসার বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নয়ন বন্ডদের মতো উঠতি বয়সী তরুণদের দিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলার পেছনে মুখ্য ভূমিকায় সুনাম দেবনাথ বলে অভিযোগ রয়েছে। বরগুনায় এ বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরেই ওপেন সিক্রেট। কিন্তু কেউই ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি এতদিন। এখন ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
সরেজমিন বরগুনা ঘুরে পুলিশ, একাধিক রাজনীতিক, পেশাজীবী ও স্থানীয় সাধারণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইয়াবা ব্যবসার একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতেই নয়ন বন্ডদের দিয়ে বিশেষ সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীর কাজই ছিল ইয়াবা বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে নিজেদের হাতপাকানো। রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের পেছনের কয়েকটি কারণের মধ্যে ইয়াবা বাণিজ্য অন্যতম। আর হত্যাকারীদের রক্ষা করতে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকা-ে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের নাম উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে বরগুনার একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে বরগুনার ইয়াবা বাণিজ্যে জড়িত সুনাম দেবনাথের আত্মীয় ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতার পুত্র শাওন তালুকদার এবং বিএনপি নেতা মাওলা মীরের পুত্র অয়ন মীর। যৌথভাবে এ মাদক বাণিজ্য দেখাশুনা করে আসছে তারা। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই ধারার রাজনীতিতে দুই জন থাকলেও ইয়াবা ব্যবসার ক্ষেত্রে উভয়ই সুনাম দেবনাথের ক্ষমতাকে পুঁজি করে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাওন তালুকদার ও অয়ন মীরের ছত্রছায়ায় অভি তালুকদার বরগুনায় ইয়াবা ব্যবসায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার নামে বর্তমানে ১৮টি মামলা রয়েছে, যার অধিকাংশই মাদকের। মাঠপর্যায়ে ইয়াবার চালান আনা, খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং টাকা সংগ্রহ করার কাজ করেন অভি তালুকদার। এই অভি তালুকদারের নিজস্ব বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করত মঞ্জুরুল আলম জন, নয়ন বন্ড, রিফাত শরীফসহ অনেকে। বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ একাধিক নেতা জানান, জন, নয়ন বন্ড এবং রিফাত শরীফ খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই একাধিক মাদকের মামলা রয়েছে। জন এবং নয়নের সঙ্গে সুনাম দেবনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বরগুনার সবাই জানে।
অনুসন্ধানকালে বরগুনায় কর্মরত জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, বরগুনায় ইয়াবার চালান আসে মূলত নদীপথে। টেকনাফ থেকে মাছের ট্রলারে সরাসরি তালতলী যে চালান আসে, তা নিয়ন্ত্রণ করেন চেয়ারম্যান দুলাল ফরাজীর শ্বশুর। তিনি সেখান থেকে চালান বরগুনায় পাঠান। এর বাইরে মাছের ট্রলারে পাথরঘাটা হয়ে বরগুনায় আসে ইয়াবা। সড়কপথে কুয়াকাটা থেকে ইয়াবার চালান বরগুনায় আসে বলে দাবি ওই কর্মকর্তার।
এদিকে বরগুনা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ১১ মে রাতে রিফাত শরীফকে ১০০ পিস ইয়াবাসহ আটক করে বরগুনা থানার এসআই সোহেল খান। রিফাত শরীফকে আটকের দৃশ্য ওই সময় মোবাইল
ফোনে ভিডিও করে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। ওই মামলায় রিফাত শরীফ ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে ছাড়া পায়।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রতিপক্ষ রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফের সম্পর্ক চরম খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে। দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে ৩ জুন নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীকে হাতুড়িপেটা করে রিফাত শরীফের নেতৃত্বে তার সহযোগীরা। এর বাইরে চলতি বছর আরও একটি মাদক মামলায় রিফাত শরীফকে আটক করে পুলিশ। বরগুনা থানার এসআই সিদ্দিকুর রহমান জানান, চলতি মাসের ১০ তারিখ আদালতে ওই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন তিনি। অভিযুক্ত দুই আসামির মধ্যে রিফাত শরীফ নিহত হওয়ার কারণে বাকি একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গোয়েন্দা পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায় রিফাত শরীফের কাছ থেকে ইয়াবা কিনে হেলাল নামে এক যুবক। ইয়াবার টাকা না দেওয়ায় গত ২৪ জুন হেলালের মোবাইল ফোন নিয়ে যায় রিফাত শরীফ। হেলালের সঙ্গে রিফাত শরীফের আগে বন্ধুত্ব থাকলেও পরবর্তী সময়ে নয়ন বন্ডের সঙ্গে হেলালের ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক তৈরি হয়। সে কারণে রিফাত শরীফের কাছ থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করার জন্য আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে ফোন করে নয়ন বন্ড। নয়নের কথায় মিন্নি ২৪ জুন রাতেই রিফাত শরীফের কাছ থেকে হেলালের মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। রিফাত শরীফ হত্যার আগের দিন ওই মোবাইল ফোন নিয়েই নয়নের বাসায় যায় মিন্নি। এর সঙ্গে রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের কোনো যোগসূত্র নেই। মিন্নি জানত না নয়ন বন্ড তার স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যা করবে। রিফাত শরীফ হত্যাকা-কে ভিন্ন খাতে নিতেই মিন্নিকে খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। তার দাবি, গডফাদারদের আড়ালে রাখতেই তার নির্দোষ মেয়েকে রিফাত শরীফ হত্যাকা-ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে সুনাম দেবনাথের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন জানান, রিফাত শরীফ হত্যার সঙ্গে মাদকের কোনো সম্পর্ক নেই। বরগুনায় মাদকের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার রয়েছে। এমপিপুত্রের বিরুদ্ধে মাদক বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পুলিশের কাছে নেই। তবে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে এবং এর সঙ্গে যে-ই জড়িত থাকুক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুত্র- আমাদের সময়

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *