মণিরামপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয় মেরামত ও সংস্কার কাজে কোটি টাকার ভূয়া বিল ভাউচার
জি, এম ফারুক আলম, মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি :
মণিরামপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেরামত ও সংস্কারে নামে সরকারের বরাদ্দ দেয়া কয়েক কোটি টাকা নিয়ে দূর্নীতির মহোৎসব চলছে। বরাদ্দ পাওয়া সিংহভাগ বিদ্যালয়ে মেরামত ও সংস্কারে নামে চলছে রঙ বদল। এছাড়া অস্থায়ী গৃহনির্মাণ, ¯িøপ (বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা), প্রাক-প্রাথমিক, রুটিন সংস্কার, ওয়াশবøক-এর বরাদ্দকৃত কয়েক কোটি টাকার কাজ নিয়েও বরাদ্দ পাওয়া অধিকাংশ বিদ্যালয়ে একই অবস্থা। আর এভাবেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা, প্রকৌশলি অফিস ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ পর্যন্ত এ টাকা ভাগ বাটোয়ারার কাজ প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে। ভূয়া বিল ভাউচার দাখিলেল মধ্যে দিয়ে টাকা উত্তোলন শুরু হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়রে অস্থায়ী গৃহনির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার, (বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা), প্রাক-প্রাথমিক, রুটিন সংস্কার, ওয়াশবøক-এর বরাদ্দকৃত কয়েক কোটি টাকার কাজ সম্পন্নের শেষ সময় ছিলো ৩১ আগস্ট। এখনো অনেক বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি। অথচ কাজ শেষ হওয়ার অনেক আগেই ভূয়া-বিল ভাউচার জমা দিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে বিল উত্তোলনের আবেদন করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্র জানায়, চলতি অর্থ বছরে (২০১৯-২০) উপজেলার ২৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ¯িøপ বাবদ প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার টাকা করে সর্বমোট ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯২৫ টাকা, অস্থায়ী গৃহ নির্মানে শাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ লাখ, মেরামত ও সংস্কারে ৫৯টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ২ লাখ টাকা করে ১ কোটি ১৮ লাখ, ক্ষুদ্র মেরামত ও সংস্কারে ১৭টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে দেড় লাখ টাকা করে ২৫ লাখ ৫০ হাজার, আম্ফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ ৬টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ১ লাখ টাকা করে ৬ লাখ, এনবিপিএ (নিড বেজড প্লেয়িং এক্সেসোরিস) কাজের ৬টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে দেড় লাখ টাকা করে ৯ লাখ, রুটিন সংস্কারে ২০২টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ৪০ হাজার করে ৮০ লাখ ৮০ হাজার, প্রাক-প্রাথমিক ২৬৭টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ১০ হাজার করে ২৬ লাখ ৭০ হাজার, ওয়াশবøকের ২৩টি বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ২০ হাজার করে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
বছরের শুরুতে বরাদ্দ দেয়া হলেও করোনা পরিস্থিতিতে কাজ করতে দেরি হয়। এ কারনে সর্বশেষ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কাজ করার সময় সীমা নির্ধারন করে দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও অনেক বিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেনি। অথচ কাজ সম্পন্নের অনেক আগেই ভূয়া-বিল ভাউচার জমা দিয়ে বিল উত্তোলনে সংশ্লিষ্ট অফিসে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দের কোন কাজই অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সম্পন্ন হয়নি। মেরামত ও সংস্কারের কাজে নয় ছয় করে অর্থ লোপাটের মহা আয়োজন করা হয়েছে।
সরেজমিন বিদ্যালয়গুলোতে গেলে এসব তথ্য উঠে আসে। উপজেলার আটঘরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে দেখা যায় মুক্তার আলী নামে একজন রঙ-এর কাজ করছে। তিনি জানান, রঙ করতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সাথে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা চুক্তি করেছেন। এ সময় কত টাকার রঙ লাগতে পারে জানতে চাইলে মুক্তার আলী জানান, ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা খরচ হবে। তিনি আরো জানান, ফজলুর রহমান নামে একজন রাজমিস্ত্রি বিদ্যালয় ভবনের কিছু জায়গায় পলেস্তারের কাজ করেছেন। পরে পাশের গ্রামে মসজিদে কাজ করতে থাকা ফজলুর রহমানের কাছে গেলে তিনি জানান, প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ টাকা হাজিরায় ১১ দিন কাজ করেছেন। তিনি আরো জানান, এ কাজে ১৬ ব্যাগ সিমেন্ট ও দুই ট্রলি বালু লেগেছে। এ হিসেবে মেরামত ও সংস্কারে বিদ্যালয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অফিসে বিলের জন্য আবেদন করা ভাউসারে শুধু শ্রমিকদের মজুরি বাবদ ৬৪ হাজার ৩৫০ টাকা, বালু, সিমেন্ট, চিপ খোয়া, খোয়া ও সিমেন্ট (৬০ ব্যাগ) বাবদ ৬৩ হাজার ৬০০ টাকা, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, আলমারি মেরামত বাবদ ১৫ হাজার ৩০০ টাকা, রঙ বাবদ ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকা দেখানো হয়েছে। অথচ বিদ্যালয়ের সিংহভাগ কাজই করা হয়নি। এমন ভাউচারের কথা জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তাপস চন্দ্র রায় বলেন, অফিসের পরামর্শে বিল ভাউচার জমা দেয়া হয়েছে। কাশিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও চলছিলো রং-এর কাজ। রঙ মিস্ত্রি আকাশ বলেন, তিনি ৮ হাজার চুক্তিতে রঙ-এর কাজ করছেন। এতে সাড়ে ১০ হাজার টাকার রঙ লেগেছে। আর কিছু পলেস্তারের কাজ হয়েছে। বাকি টাকার কথা বলতেই প্রধান শিক্ষক মাসুদ পারভেজ জানান, কোন টাকায় থাকবে না।
ত্রিপুরাপুর বিদ্যালয়ে প্রায় ৬১ লাখ টাকা তিন তলা ভবনের কাজ শেষের পথে। একই স্কুলে মেরামত ও সংস্কারের জন্যও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অবশ্য মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছে পাশের ভবনে। কিন্তু যেখানে ৬১ লাখ ব্যয়ে ভবন নির্মান শেষের পথে সেখানে ফের ২ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলি রবিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই।
বাগডোব-নওয়াপাড়া বিদ্যালয়ে কোন কাজই হয়নি। জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দীন বলেন, ভবনের অবস্থা ভাল না হওয়ায় কোন রাজমিস্ত্রি ভবনে কাজ করতে চাইনি। এমন ভবন সংস্কারে কেন বরাদ্দ দেয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা প্রকৌশলি রবিউল ইসলাম বলেন, যদি না লাগে তাহলে সরকারি অর্থ অপচয় করা হবে না। কিন্তু কিভাবে বিল উত্তোলনে বিল ভাউচার জমা দেয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দীন বলেন, অফিসের নির্দেশে করা হয়েছে। একই ভাবে সৈয়দ মাহমুদপুর, পলাশি রাজবাড়ি, রাজবাড়িয়া, এরেন্দা, স্মরণপুরসহ অধিকাংশ বিদ্যালয়ের পুরানো রঙ-এর উপর (যা ভাল ছিলো) নতুন করে রঙ করা হয়েছে।
এসব বিষয় জানতে চাইলে উপজেলা শিক্ষা অফিসার সেহেলী ফেরদৌস বলেন, বিদ্যালয়ের কাজ সম্পন্ন না হলে বিলের জন্য আবেদন করার কথা না। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।