গৌরীপুরের কেল্লা বোকাইনগরের চিত্র ও দুর্গের ইতিহাস ( পর্ব -১)

মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার:
ইংরেজিতে ‘বোকাইনগর ফোর্ট’; বাংলায় ‘বোকাইনগর দুর্গ ‘। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে এর আরও একটি নাম আছে—’ কেল্লা বোকাইনগর। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে প্রায় আধঘণ্টার পথ। যে কোন ধরণের ছোটোখাটো যানবাহন নিয়ে পৌঁছা যায় কেল্লার নিকটে। ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরপুর বোকাইনগর গ্রামটিতে গেলেই দেখা যাবে ৭০০ বছরের পুরোনো নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার, সম্রাট শাহজাহান আমলে নির্মিত শাহী মসজিদ, চাঁদরায়ের স্মৃতিবিজরিত চাঁদের মন্দির বা মঠ, শত শত বছরের পুরোনো গোসাইবাড়ি মন্দিরের সেই স্থাপনা আজও ঠিকে আছে ইতিহাসের অংশ হিসেবে। বগুড়ার শেলবর্ষ ও ছিন্দাবাজু পরগনা, ময়মনসিংহ জেলার মোমেনসিং পরগনা ও জামালপুর জেলার জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার এবং গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের শিরোমণি ও প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহ্মণ জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বিতীয় রাজবাড়ি বোকাইনগরের বাসাবাড়ি যা পূর্বে বাঁশবাড়ি (কামরূপদের নামকরণ) বা মোমেনসিং পরগনার রাজবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। তার প্রথম তরফের ছেলে কৃঞ্চগোপালের দত্তক পুত্র ও নবাব সিরাজের অপর স্ত্রী আলেয়া (হীরা বা মাধুবী) এবং তাঁর গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান ও গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার যুগল কিশোর রায় চৌধুরী পরগনার প্রাচীন রাজধানী শহর বোকাইনগরের কালেক্টরির খারিজা তালুকে জমি ক্রয় বা ইংরেজদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে একটি কালীবাড়ি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া গৌরীপুর হতে বোকাইনগর কালীবাড়ি পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের জন্য একটি রাস্তা তৈরি করেন। রাস্তার দু’ধারে ২৪০ বছর আগের কয়েকটি দেবদারু গাছ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। দেখে মনে হবে এই বুঝি ৪০-৫০ বছরের আগের গাছ ! বাস্তবতা ভিন্ন। রাস্তাসহ সেই পুরোনো গাছগুলো আজও নবাব সিরাজের পুত্র যুগলকিশোরের স্মৃতি বহন করছে।
১৫ শতকের আগে বোকাইনগর দুর্গের উৎপত্তি সম্পর্কিত কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একটি কিংবদন্তি রয়েছে যে বোকাই নামে একজন কোচ প্রধান দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। ইতিহাসবিদরাও বিশ্বাস করেন যে বোকাইনগরে হাজার বছর আগেও জনবসতি ছিল। সেখানে কামরূপ জাতি- কোচ. মেচ, হাজং গারো, ভূটিয়া নামে বহু আদিবাসী বাস করত। এখনও জনশ্রুতি আছে যে, কামরূপ জাতির বোকাই নামে একজন কোচ রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর নাম অনুসারে স্থানটি বোকাইনগর নামে পরিচিত। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, স্বনামধন্য শৌখিন পুরাতাত্ত্বিক, গবেষক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার মতে, একাদশ শতাব্দীতে এখানে রাজত্ব করতেন কিন্তু এটি নির্ভরযোগ্য তথ্য নয়। নাজিমউদ্দীন আহমদ তাঁর Discover the Monuments of Bangladesh গ্রন্থে বোকাইনগর সম্বন্ধে একটি নির্ভরযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন: “The site of Bokainagar which is situated about twelve miles east of Mymensingh town on the eastern bank of the Brahmaputra river is an important medieval defence post. It is said to have been established in the 15th century by a certain local chief called Bokai when the ancient kingdom of Kamrup was beginning to disintegrate. Soon after it was annexed by Hussain Shah in 1495 and he placed his son Nusrat Shah in charge of it.” বঙ্গানুবাদ: “ময়মনসিংহ শহরের ১২ মাইল পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী তীরে বোকাইনগর নামে একটি মধ্যযুগীর প্রাচীন দুর্গ নির্মিত হয়। এই দুর্গটি বোকাই নামক একজন কোচ রাজা পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করেন। রাজ্যের পতনের যুগে বোকাইনগরের অভ্যুত্থান। মুসলিম আমলে ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহ কর্তৃক বোকাইনগর অধিকৃত হয় এবং হোসেন শাহ তদীয় পুত্র নছরত শাহকে এ অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন।” পরবর্তীকালে মুঘলদের দ্বারা বিতাড়িত হলে পাঠান শাসক খাজা উসমান ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি দুর্গটি পুনঃনির্মাণ করে সপরিবারে বসবাস করতে থাকেন। ১৯ জুন ২০১৭ ইং তারিখে ‘দি নিউ নেশন’ ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত শিরোনাম “The history of two forts in Gouripur, Mymensingh” ফিচারে বোকাইনগর সম্বন্ধে অনেক নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছ। যেমন A lot of tales surround the construction of the Fort of Bokainagar. The word ‘Bokai’ has been derived from the Persian title Khwaja, lord, master, Sufi. Its synonym is Hoxha, or Hodja, is an Albanian surname as Ishmael Bokai. Khawaja or Khwaja is from the Iranian word Khwja, New Persian Kh?jé (Persian). This title is also used in the Middle East, South Asia, and Central Asia. The title refers to the holder as Master, Lord. It is also closely related to other terms in Sufism. It is assumed that the fort was under many rulers and commanders from 12th century or before. Once it was under Kamrupa. Once it was a city of Sufism or khawajas. Bokainagar was named after the Astana of Bokais or Sufism. বঙ্গানুবাদ: “বোকাই’ শব্দটি এসেছে ফার্সি উপাধি খাজা, প্রভু, ওস্তাদ, সুফি থেকে। এর প্রতিশব্দ হল Hoxha, বা Hodja, ইসমাইল বোকাই হিসাবে একটি আলবেনিয়ান উপাধি। খাজা বা খাজা ইরানি শব্দ খাজা, (ফার্সি) শব্দ থেকে এসেছে। এই শিরোনামটি মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য এশিয়াতেও ব্যবহৃত হয়। এটি সুফিবাদের অন্যান্য পরিভাষার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ধারণা করা হয় যে দুর্গটি ১২ শতক বা তার আগে অনেক শাসক ও সেনাপতির অধীনে ছিল। একবার এটি কামরূপের অধীনে ছিল। একসময় এটি ছিল সুফিবাদ বা খাজাদের শহর। বোকাইনগরের নামকরণ করা হয়েছিল বোকাইস বা সুফিবাদের আস্তানার নামানুসারে। বোকাইনগরে ইউনিয়নে ‘খাজান্দর’ নামে একটি গ্রাম রয়েছে। ঐতিহাসিক বোকাইনগরে নিদর্শন খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করা হয় ৮টি প্রাচীন নিদর্শন। তার মধ্যে রয়েছে মধ্যযুগের বেশ কয়েকটি মাজার শরীফ। গবেষণা করে জানা যায়, মুসলিম অধিকারের আগে বোকাইনগরের পূর্ব নাম ছিল বাঁশবাড়ি। কামরূপ শাসনামলে রাজ্যগুলোর নাম হয়েছে গাছগাছালি ও শস্যের নাম এবং রাজার বাড়ি কেন্দ্র করে। যেমন জঙ্গলবাড়ি, বাইগনবাড়ি, সরিষাবাড়ি, নালিতাবাড়ি, কমলাবাড়ি, বড়ইবাড়ি ইত্যাদি এক সময়ে কামরূপদের রাজ্য ছিল। হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রা.) অথবা কোন সফি সাধকের কাছে বোকাইনগরের কামরূপ রাজা ইসলাম গ্রহণের পর তার নতুন নাম হয় বোকাই কোচ রাজা এবং রাজ্যের নাম হয় বোকাইনগর। সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে বোকাইনগরের প্রাণকেন্দ্রে আজও ইতিহাসকে বহন করে চলছে মধ্যযুগের আধ্যাতিক এক সফি সাধক নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার শরীফ ।
হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর সমসাময়িক হিসাব অনুযায়ী সাতশ’ বছর ধরে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) এর মাজার শরীফটি প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) এর নামানুসারে মুঘল আমলে নিজামাবাদ শহর প্রতিষ্ঠি হয়। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত দিক পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী সৃষ্টি হলে পর্যায়ক্রমে নিজামাবাদ শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় । বর্তমান নিজামাবাদ একটি বড় মৌজা। নিজামাবাদ মৌজার মাঝখানে ছোট ছোট মৌজা রয়েছে। ধারণা করা হয় ছোট ছোট মৌজাগুলো এক সময়ে পানির মধ্যে ছিল। যার ফলে মৌজাটি তিন-চার খণ্ডে বিভক্ত। একসময় গৌরীপুর উপজেলার কেল্লা বোকাইনগর ও কেল্লা তাজপুর বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে অন্যতম দুইটি প্রধান স্থান ছিল। ধনে, জনে, ঐশ্বর্যে, সভ্যতায় এই দুই স্থানই তখন শ্রেষ্ঠ ছিল। বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়ায় কেল্লার ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ‘সুলতান দ্বিতীয় সাইফুদ্দীন ফিরুজ শাহ (১৪৮৬-১৪৮৯)-এর প্রতিনিধি মজলিস খান হুমায়ুন তাজপুর দুর্গ এবং বোকাইনগর নির্মাণ করেন। ১৪৯৫ সালে দুর্গ দুটি হোসেন শাহের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং তিনি তার পুত্র নুসরত শাহকে অধিকর্তা নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে খাজা উসমান মুগলদের কাছে পরাজিত হয়ে উড়িষ্যা থেকে পালিয়ে ঈসা খানের কাছে আশ্রয় নেন এবং বোকাইনগরের সামন্তরাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি বোকাইনগর দুর্গ পুনঃনির্মাণ করে এটিকে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এখান থেকে মুঘলদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।’ বোকাইনগর থেকে ৮ কিলো উত্তর-পূর্বে সুরিয়া নদীর তীরে কেল্লা তাজপুর অবস্থিত। সুলতান সাইফুদ্দীন ফিরুজ শাহের (১৪৮৬-১৪৮৯) এক সেনাপতি মজলিস খান হুমায়ন তার কামরূপ অভিযানকালে কেল্লা তাজপুর নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে রিচার্ড এম ইটন তার ‘The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760′ বিখ্যাত গ্রন্থে উল্লেখিত ময়মনসিংহের টাকশালের স্থান তাজপুরের (১৪৫৯) সময় ও তথ্য অনুযায়ি জানা যায়, ওই সময়ে বাংলার পরবর্তী ইলিয়াসশাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) আমলে কেল্লা তাজপুরে একটি টাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান জনশ্রুতিতে এ টাকশালটি পোদ্দারবাড়ি নামে পরিচিত। এ থেকে বোঝা যায় কেল্লা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল টাকশাল প্রতিষ্ঠা হওয়ার অনেক আগে। তবে বিভিন্ন সময়ে কেল্লা দখল বা ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। পরিশেষে গৌরীপুরের কেল্লা বোকাইনগরের চিত্র ও দুর্গের ইতিহাসের ২য় পূর্বে খাকবে কেল্লার আকার আয়তন, বুরুজ, পরিখা, খাজা উসমানের ভূমিকা, যুদ্ধের ধরণ ও সময়কাল ইত্যাদি। গৌরীপুরের দু’টি কেল্লার তথ্যভিত্তিক ইতিবৃত্ত তুলে ধরার জন্য ২০১৫ সাল হতে কাজ করছে ৩টি স্থানীয় সামাজিক সংগঠন- ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন, এসিক এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স।
মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী