Type to search

করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগে শরীরে চার গুন এন্টিবোডি তৈরি হয়েছে

জাতীয়

করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগে শরীরে চার গুন এন্টিবোডি তৈরি হয়েছে

অপরাজেয় বাংলা: ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ আলম গত মার্চে টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন। মার্চের শেষে তিনি টিকার প্রথম ডোজ নেন। এরপর টিকার সংকট থাকায় আর দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি। তাই তিনি শঙ্কায় আছেন টিকার কার্যকারিতা নিয়ে। তার প্রশ্ন, এতদিন পর দ্বিতীয় ডোজ যদিও দেওয়া হয়, তাতে লাভ আছে কিনা!

শুধু শাহনেওয়াজ আলম নন, তার মতো প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ মানুষ এখনও অন্ধকারে আছেন। কারণ অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটে তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়ে এখন তারা দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন। তাদেরকে সেরামের কোভিশিল্ডের অথবা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়েই দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। কারণ দুই কোম্পানির মিক্স ডোজ টিকা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এখন পর্যন্ত কোনও নির্দেশনা নেই।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন কোভিশিল্ডের দুই ডোজের ব্যবধান ১০ মাস বা ৪৫ সপ্তাহ হলে তা আরও বেশি কার্যকর বলে দাবি করেছে নতুন এক গবেষণা। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের একদল গবেষক গত ২৮ জুন জানিয়েছেন, দুই ডোজের ব্যবধান ৪৫ সপ্তাহ হলে শরীরে বেশি অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া উভয় ডোজ নেওয়ার ৬ মাস পর একটি বুস্টার ডোজ নিলে তা করোনার সকল ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে বলেও দাবি করা হয়েছে গবেষণায়।

কানাডার পাবলিক হেলথ অব অন্টারিও’র করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, টিকার ডোজের সঙ্গে আক্রান্ত, মৃত্যু, হাসপাতালের চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়ার একটা সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত কেসগুলোর সঙ্গে ভ্যাকসিনেশন ডেটা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানায় বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক অল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হতেও পারে, যেহেতু কোনও ভ্যাকসিন শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেসগুলো পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন বলছে, ভ্যাকসিন গ্রহণের কারণে উপসর্গযুক্ত সংক্রমণ, তীব্র অসুস্থতা এবং সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

গবেষণা বলছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে জুনের শেষ নাগাদ প্রায় ৯৮ লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের একটি ডোজ গ্রহণ করেছে। এসব ভ্যাকসিনের মধ্যে আছে ফাইজার, মডার্না কিংবা অ্যাস্ট্রাজেনেকা। একই সময়ে ৪ লাখ ৪১৩ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পাবলিক হেলথ অফিশিয়ালরা বলছেন, মোট শনাক্তের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছিলেন; যেখানে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের দুই ডোজ নেওয়া হয়েছিল। আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্ক জনগোষ্ঠী বেশি ছিলেন।

বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের নিয়ে গবেষণা চলমান আছে। দেশে করোনার টিকা গ্রহণের পর নাগরিকদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। এক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলের বরাত দিয়ে একথা জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে এ গবেষণা করছে। এতে বলা হয়- গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১২০ জন প্রথম ডোজ কোভিশিল্ড টিকা গ্রহণকারীর টিকা গ্রহণের এক মাস পর ৯২ শতাংশের ও দুই মাস পর ৯৭ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সব বয়সী টিকা গ্রহণকারীর শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্যান্য অসুস্থতা (কো-মরবিডিটি) থাকা বা না থাকার সঙ্গে অ্যান্ডিবডির উপস্থিতির তেমন কোনও পার্থক্য পাওয়া যায়নি। টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে যারা কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের শরীরে চার গুণ বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।

আইইডিসিআর জানায়, এই গবেষণা চলমান। টিকা গ্রহণকারীদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির আরও হালনাগাদ তথ্য ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে। গবেষণায় দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৬ হাজার ৩০০ টিকা গ্রহণকারীর মধ্যে টিকা গ্রহণের পর দুই বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে।

দেশে গণহারে কোভিশিল্ডের ভ্যাকসিন শুরু সময় স্বাস্থ্য অধিদফতর বলেছিল, প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে ২৮ দিন পর। এখন ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ পর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম তখন বলেন, এর আগে আমাদের জানানো হয়েছিল প্রথম ডোজ দেওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। তবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার নতুন তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজ দেওয়ার দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে। নতুন নিয়ম জানার পর আমরা পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, যাদের প্রথম ডোজ নেওয়ার ৮ সপ্তাহ হয়েছে, তাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। ১২ সপ্তাহের মধ্যে যে কোনও সময় টিকা নিলেই হবে।

প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর করোনা আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি ৯৯ দশমিক ৫ ভাগ কমে যায় বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের একদল গবেষক। এ ছাড়া আক্রান্ত ৯২ ভাগ রোগীরই বাড়তি অক্সিজেন প্রয়োজন হয়নি। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) গবেষকরা দুই মাস গবেষণা শেষে এই ফলাফল পেয়েছেন। গবেষণায় ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সিভাসু ল্যাবে পরীক্ষা করা ছয় হাজার ১৪৬ জনের নমুনার মধ্যে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া এক হাজার ৭৫২ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণা চালায় চট্টগ্রামের ৭ জনের এক গবেষক দল।

গবেষকরা জানান, টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর করোনা আক্রান্ত ২০০ মানুষের ওপর গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে করোনাভাইরাসের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ শ্বাসকষ্ট ৮৮ ভাগের মধ্যে তেমন ছিল না। আক্রান্তদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে যেতে হয়নি। বাকি ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ (৩৫ জন) ভর্তি হলেও তাদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যায়নি। কেবল বার্ধক্যজনিত ও অন্যান্য সমস্যায় ভোগা রোগীরা টিকা নেওয়ার পর করোনা আক্রান্ত হলে অতিরিক্ত অক্সিজেন দিতে হয়েছে বলেও জানান তারা।

এরপর দ্বিতীয় দফায় চাঁদপুর এবং চট্টগ্রামের প্রায় ১৩ হাজার ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার অপর আরেক গবেষণা করেন তারা। গত ২ জুলাই গবেষকরা জানান, মোট নমুনা পরীক্ষার মধ্যে আক্রান্ত ৬৩ জন শুধু প্রথম ডোজ এবং ৬৪ জন দুই ডোজই নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে আক্রান্তের হার মোট নমুনা পরীক্ষার যথাক্রমে দশমিক ৪৮ এবং দশমিক ৪৯ শতাংশ।

সিভাসুর পক্ষ থেকে জানানো হয়, দ্বিতীয় ডোজের পর আক্রান্তদের ওপর তুলনামূলক এই বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, টিকা নিলে করোনাভাইরাস মোকাবিলা সহজ হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের টিকা না নেওয়া রোগীদের মধ্যে ১৩৭ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয়। অথচ প্রথম ডোজ নেওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭ জন এবং দুই ডোজের পর আক্রান্ত ৩ জনকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে।

গবেষণার ফলাফল থেকে আরও জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তি টিকা না নেওয়া ৮৩ জনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। এর মধ্যে ৭৯ জনের অতিরিক্ত অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত এসব রোগীর মধ্যে অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা সর্বনিম্ন ৭০ শতাংশ পাওয়া যায়। অপরদিকে টিকা নেওয়া রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিক (৯৬.৭ শতাংশ) পাওয়া যায়।

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *